বৈদিক হিন্দুধর্মে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ।।

প্রশ্ন: মূর্তিপূজা কোত্থেকে এলো?

উত্তর: মূর্তিপূজা বৈদিক হিন্দুধর্মবহির্ভূত চর্চা। স্বার্থান্বেষী মহল এটি জৈনদের কাছ থেকে এনে সংযোজন করেছে।

প্রশ্ন: জৈনরা মূর্তিপূজার ধারণা কিভাবে পেয়েছে?

উত্তর: নিজেদের মূর্খতা থেকে।

প্রশ্ন: জৈনরা বলে- শান্ত, ধ্যানমগ্ন, উপবিষ্ট মূর্তি দর্শন করা হলে নিজের আত্মার শুভ পরিণাম সেরূপই হয়ে থাকে।

উত্তর: জীব সচেতন, কিন্তু মূর্তি অচেতন। তবে কি জীবও মূর্তির মতো জড় হয়ে যাবে? মূর্তিপূজা তো একটি পাষণ্ড মত; জৈনরা এটা চালু করেছে।

প্রশ্ন: বৈষ্ণব ও অন্যান্য সম্প্রদায় মূর্তিবিষয়ে জৈনদের অনুকরণ করেনি। কেননা, বৈষ্ণবদের মূর্তি আর জৈনদের মূর্তি ভিন্ন হয়ে থাকে।

উত্তর: হ্যাঁ, একথা সত্য যে, জৈনদের অনুকরণে মূর্তি নির্মিত হলে জৈনদের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যেত। জৈনরা ‘বিবস্ত্র মূর্তি’ তৈরি করে, আর বৈষ্ণবরা ‘শৃঙ্গারযুক্ত মূর্তি’ নির্মাণ করে। জৈনরা শঙ্খ-ঘণ্টা-কাঁসর ইত্যাদি বাজায় না। কিন্তু বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায় মহাকোলাহল করে থাকে।

এভাবেই তো বৈষ্ণবাদি সম্প্রদায় জৈনদের ‘জাল’ থেকে রক্ষা পেয়ে নতুন ‘লীলায়’ জড়িত হয়েছে! তারা ব্যাস প্রমুখ মহর্ষির নামে মনগড়া অসম্ভব গল্প রচনা করে সেসব গ্রন্থের ‘পুরাণ’ নাম দিয়ে কথকতাও আরম্ভ করেছে।

পাথরের মূর্তি নির্মাণ করে গুপ্ত কোনো পর্বতে, অরণ্যে রেখে আসতো। পরে চেলাদের মাধ্যমে প্রচার করতো, রাতে মহাদেব, পার্বতী, রাধাকৃষ্ণ, সীতারাম, লক্ষ্মীনারায়ণ, ভৈরব, হনুমান প্রভৃতি তাকে স্বপ্নে বলে দিয়েছেন, ‘আমি অমুক স্থানে আছি, আমাকে সে স্থান থেকে এনে মন্দিরে স্থাপন করো এবং তুমি আমার পূজারী হলে মনোবাঞ্ছিত ফল প্রদান করবো।’

জ্ঞানান্ধ ধনীরা এমন কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে জিজ্ঞাসা করতো, ‘এখন এই মূর্তি কোথায় আছে?’ তখন স্বার্থান্বেষীরা বলতো, ‘অমুক পর্বতে বা অরণ্যে আছে; আমার সঙ্গে চলো, দেখাব।’ তখন জ্ঞানান্ধ সেই ধূর্তের সঙ্গে সে স্থানে গিয়ে মূর্তিদর্শন করতো এবং আশ্চর্য হয়ে তার পায়ে পড়ে বলতো, ‘আপনার এই দেবতার বড়ই কৃপা; এবার একে আপনি নিয়ে চলুন, আমি মন্দির নির্মাণ করে দিব। মন্দিরে এই দেবতার স্থাপনা করে আপনিই পূজা করবেন। আমরাও মনোবাঞ্ছিত ফল লাভ করবো।’

একজনের এরূপ লীলাখেলা রচনার পর দেখাদেখি অন্যান্য স্বার্থান্বেষীরাও তাদের জীবিকার্থে ছলনা-কপটতা নিয়ে মূর্তি স্থাপন করতে লাগলো।

প্রশ্ন: পরমেশ্বর নিরাকার, তাই তাঁকে ধ্যান করা যায় না। এজন্য অবশ্যই মূর্তি থাকা উচিত। ভেবে দেখতে পারেন, যে লোক কিছুই করে না, সেও যদি মূর্তির সামনে গিয়ে করজোড়ে পরমেশ্বরের নাম স্মরণ ও নাম উচ্চারণ করে, এতে ক্ষতি কী?

উত্তর: পরমেশ্বর নিরাকার এবং সর্বব্যাপক। তাঁর মূর্তিই নির্মিত হতে পারে না। আর যদি মূর্তি দর্শনমাত্রই পরমেশ্বরের স্মরণ হয়, তাহলে ঈশ্বরসৃষ্ট পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, বনস্পতি ইত্যাদি বহুকিছুই তো রয়েছে, যাতে রয়েছে বিস্ময়কর গঠনকৌশল, সেসব দেখে কি পরমেশ্বরের স্মরণ হতে পারে না?

মূর্তির সামনে উপস্থিত না হলে যদি পরমেশ্বরের স্মরণ না হয়, তবে তো অপরাধীরা নির্জন স্থান পেয়ে চুরি, লাম্পট্য ইত্যাদি না-না কুকর্মে রত হতে পারে। কেননা, সে জানে যে এসময় এখানে কেউ আমাকে দেখছে না। ফলে সে অনর্থ না করে পারে না। এরূপ পাষাণমূর্তির পূজায় অনেক দোষ ঘটে।

অন্যদিকে, যিনি পাষাণমূর্তিকে না মেনে সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী এবং ন্যায়কারী পরমাত্মাকে সর্বত্র জানেন এবং মানেন, তিনি তাঁকে সকলের সদসৎ কর্মের দ্রষ্টা বলেই স্মরণ করেন এবং তিনি স্বয়ং পরমাত্মা থেকে ক্ষণমাত্রও দূরে নন জেনে কুকর্ম করাতো দূরে থাকুক, কুকর্মের চিন্তাও করতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন, যদি আমি কথা, চিন্তা বা কাজ দিয়ে কোনো কুকর্ম করি, তবে অন্তর্যামীর ন্যায়বিধানে কিছুতেই দণ্ড থেকে অব্যাহতি পাবো না।

প্রশ্ন: আমরাও জানি যে, পরমেশ্বর নিরাকার, কিন্তু যেকোন সাকার রূপ ধারণ করতে পারেন। তিনি শিব, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য, দেবী প্রভৃতির শরীর ধারণ করে এবং রাম, কৃষ্ণ প্রমুখ রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একারণেই তাঁদের মূর্তি নির্মিত হয়। এও কি মিথ্যা?

উত্তর: অবশ্যই মিথ্যা। কারণ ‘অজ একপাৎ’, ‘অকায়ম্’ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে বেদে বলা হয়েছে, পরমেশ্বর জন্ম-মরণ রহিত। তিনি শরীর ধারণ করেন না। তাই এসব যুক্তি দিয়ে পরমেশ্বরের অবতারও কখনও সিদ্ধ হতে পারে না। তিনি আকাশবৎ সর্বত্র ব্যাপক ও অনন্ত। তিনি সুখদুঃখ, দৃশ্য প্রভৃতি সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। তিনি এক ক্ষুদ্র বীর্যে, গর্ভাশয়ে এবং ক্ষুদ্র শরীরে কিরূপে আসতে পারেন?

প্রশ্ন: যেহেতু পরমেশ্বর সর্বব্যাপক, সেহেতু তিনি মূর্তিতেও আছেন। কাজেই যেকোন পদার্থে ইচ্ছামত ভাবনা আরোপ করে তাঁর পূজা করা কি ভালো না?

উত্তর: বরং চিন্তা করো, যেহেতু পরমেশ্বর সর্বব্যাপক, সেহেতু তাঁকে কোনো বস্তু-বিশেষে ভাবনা করা, অন্যত্র না করা, এ যেন কোনো চক্রবর্তী রাজাকে পুরো রাজ্যসত্তা থেকে বিচ্যুত একটি ক্ষুদ্র পর্ণকুটীরের অধিপতি মনে করা। দেখ, এটা কতো বড় অপমান!

যদি পরমেশ্বরকে ব্যাপক বলেই মানো, তাহলে উদ্যান থেকে পুষ্প-পত্র ছিন্ন করে তাঁকে অর্পণ করো কেন? চন্দন ঘর্ষণ-লেপন করো কেন? ধুপ জ্বালাও কেন? ঘণ্টা-কাঁসি-ঘড়িয়াল-ঝাঁজে লাঠি দিয়ে আঘাত করো কেন? পরমেশ্বর তোমার হাতেও আছেন, তবে হাতজোড় করো কেন? তিনি অন্ন এবং জলাদিতে আছেন, তবে তাঁকে নৈবেদ্য অর্পণ করো কেন? তিনি জলে আছেন, তবে তাঁকে স্নান করাও কেন? ‘আমি পরমেশ্বরের পূজা করছি’, এমন মিথ্যা কথা না বলে ‘আমি প্রস্তরাদির পূজারী’ – এই সত্য কথাটাই বলো!

প্রশ্ন: হ্যাঁ মহাশয়! যতক্ষণ বেদমন্ত্র দিয়ে আবাহন করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত দেবতা আগমন করেন না। কিন্তু আবাহন করা হলে তৎক্ষণাৎ দেবতা আগমন করেন এবং বিসর্জন করা হলে চলেও যান।

উত্তর: যদি মন্ত্র পড়ে আবাহন করলেই দেবতা উপস্থিত হন, তবে মূর্তি সচেতন হয় না কেন? বিসর্জন করলেই তিনি চলে যান কেন? সেই দেবতার কোত্থেকে আগমন ঘটে, কোথায়ই বা তিনি চলে যান?

অন্ধরা, শোনো! পরমাত্মা আগমনও করেন না, গমনও করেন না। যদি মন্ত্রবলে পরমেশ্বরকে আবাহন করে আনাতে পারো, তবে সেই মন্ত্রবলে স্বীয় মৃতপুত্রের শরীরে জীবনকে আবাহন করে আনতে পারো না কেন? শত্রুশরীরের জীবাত্মা বিসর্জন করে তাকে মারতে পারো না কেন?

নির্বোধ, সরলমতি ভাইসব! স্বার্থান্বেষীরা তোমাদেরকে প্রতারিত করে স্বার্থসিদ্ধ করে থাকে। বেদে পাষাণাদি মূর্তির পূজা করা, পরমেশ্বরের আবাহন-বিসর্জন করার একটি অক্ষরও নাই।

প্রশ্ন: “প্রাণা ইহাগচ্ছন্তু সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা।
আত্মেহাগচ্ছতু সুখং চিরং তিষ্ঠতু স্বাহা।
ইন্দ্রিয়াণীহাগচ্ছন্তু সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা।।”

আমরা তো জানি এসব বেদমন্ত্র রয়েছে। আপনি নাই বলছেন কেন?

উত্তর: আরে ভাই। একটু অনুসন্ধান করো! এগুলি কপোলকল্পিত, বামমার্গীদের বেদবিরুদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থোক্ত পোপরচিত পংক্তি, মোটেও বেদ-বচন নয়!

প্রশ্ন: তন্ত্র কি মিথ্যা?

উত্তর: হ্যাঁ, সম্পূর্ণ মিথ্যা! বেদে যেমন আবাহন, প্রাণ-প্রতিষ্ঠা, পাষাণমূর্তি বিষয়ে একটি মন্ত্রও নাই, সেরূপ ‘স্নানং সমর্পয়ামি’ ইত্যাদি বচনও নাই। অর্থাৎ এতটুকুও নাই যে, ‘পাষাণাদিমূর্ত্তিং রচয়িত্বা মন্দিরেষু গন্ধাদিভি রর্চয়েৎ’, অর্থাৎ পাষাণ-মূর্তি নির্মাণ করে মন্দিরে স্থাপন করবে এবং চন্দন, আতর, তণ্ডুল ইত্যাদি দিয়ে পূজা করবে – এমন কথার লেশমাত্রও নাই।

প্রশ্ন: যদি বেদে বিধি না থাকে, তবে খণ্ডনও থাকার কথা না। যদি খণ্ডন থাকে, তবে মূর্তি থাকলেই তো খণ্ডন হতে পারে!

উত্তর: বিধি তো নাই-ই, অধিকন্তু পরমেশ্বরের স্থলে অন্য কোনো পদার্থকে পূজনীয় না মানার নির্দেশ আছে। শোনো, এইরূপ আছে –

“অন্ধতমঃ প্রবিশন্তি য়ে সম্ভুতি মুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য় উ সম্ভুত্যা রতাঃ।”। ১।। যজুঃ।।অ০৪০।ম০৯।।

যারা ব্রহ্মের স্থানে ‘অসম্ভুতি’ অর্থাৎ অনুৎপন্ন অনাদি প্রকৃতি কারণের উপাসনা করে, তারা অন্ধকার অর্থাৎ অজ্ঞানতা এবং দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়। আর যারা ব্রহ্মের স্থানে ‘সম্ভুতি’ অর্থাৎ কারণ থেকে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিবাদি ভূত, পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে, তারা উক্ত অন্ধকার অপেক্ষাও অধিকতর অন্ধকার অর্থাৎ মহামূর্খ চিরকাল ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হয়ে মহাক্লেশ ভোগ করে।।১।।

“ন তস্য প্রতিমা অস্তি।”।২।।যজুঃ।।অ০৩২।।ম০৩।।

যিনি সমস্ত জগতে ব্যাপক, সেই নিরাকার, পরমাত্মার প্রতিমা, পরিমাণ, সাদৃশ্য অথবা মূর্তি নাই।।২।।

“য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতি য়েন চক্ষুংষি পশ্যন্তি।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপামতে।।৩।।
য়চ্ছ্রোত্রে ন শৃণোতি য়েন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে।।৪।।
য়ৎপ্রাণেন ন প্রাণিতি য়েন প্রাণঃ প্রণীয়তে।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে।”।৫।। কেনোপনি০।।

যিনি চোখ দিয়ে দৃষ্ট হন না কিন্তু যাঁর দ্বারা চোখ দেখতে পায়, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো এবং তাঁরই উপাসনা করো। আর যা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন সূর্য-বিদ্যুৎ-অগ্নি আদি জড় পদার্থ আছে, তাদের উপাসনা করো না।।৩।।

যাঁকে কান দিয়ে শোনা যায় না, কিন্তু যাঁর দ্বারা কান শ্রবণ করে, তুমি তাঁকে ব্রহ্ম বলে জানো এবং তাঁরই উপাসনা করো। তাঁর থেকে ভিন্ন শব্দ প্রভৃতির উপাসনা করো না।।৪।।

যিনি প্রাণ দিয়ে চালিত হন না, কিন্তু যাঁর দ্বারা প্রাণ গতিশীল, সেই ব্রহ্মকেই তুমি জানো এবং তাঁরই উপাসনা করো। তাঁর থেকে ভিন্ন বায়ুর উপাসনা করো না।।৫।।

তাহলে অপূর্ববিধি হয় না কোথায়!

নিষেধ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত উভয়েরই হয়ে থাকে। প্রাপ্তের নিষেধ – যেমন কেহ কোথাও বসে আছে, তাকে সে স্থান থেকে তুলে দেওয়া। অপ্রাপ্তের নিষেধ – যেমন (কেহ বললো), ‘হে পুত্র, তুমি কখনও চুরি করো না, কূপে পতিত হয়ো না, অসৎ-সংসর্গ করো না’। মানুষের জ্ঞানে অপ্রাপ্ত, পরমেশ্বরের জ্ঞানে প্রাপ্তের নিষেধ করা হয়েছে। এ কারণে পাষাণাদি মূর্তির পূজা অত্যন্ত নিষিদ্ধ।

প্রশ্ন: মূর্তিপূজা করলে পুণ্য না থাকুক, পাপও তো নাই?

উত্তর: কর্ম দুই প্রকার। প্রথম, বিহিত – বেদে যেমন সত্যভাষণাদি কর্তব্য বলে প্রতিপাদিত হয়েছে। দ্বিতীয়, নিষিদ্ধ – বেদে যেমন মিথ্যাভাষণাদি অকর্তব্য বলা হয়েছে। বিহিত করলে ধর্ম, না করলে অধর্ম। সেরূপ নিষিদ্ধ কর্ম করলে অধর্ম এবং না করলে ধর্ম।

যখন তোমরা বেদনিষিদ্ধ মূর্তিপূজা প্রভৃতি কর্ম করো, তখন তোমরা পাপী হবে না কেন?

প্রশ্ন: সাকারে মন স্থির হয়, কিন্তু নিরাকারে মন স্থির হওয়া কঠিন। এজন্য মূর্তিপূজা থাকা উচিত।

উত্তর: সাকারে মন কখনও স্থির হতে পারে না। কারণ, মন সাকারকে সহসা গ্রহণ করে, তারই এক-এক অবয়বের মধ্যে বিচরণ করে এবং অন্য বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়। কিন্তু নিরাকার অনন্ত পরমাত্মার গ্রহণে মন যথাশক্তি প্রবল বেগে ধাবিত হলেও তার অন্ত পায় না। নিরবয়ব বলে মন চঞ্চলও থাকে না। কিন্তু তাঁর গুণ-কর্ম-স্বভাব বিবেচনা করতে করতে মন আনন্দে মগ্ন হয়ে স্থির হয়ে যায়।

আর যদি সাকারে মন স্থির হতো, তাহলে জগতে সকলের মনই স্থির হতো। কারণ জগতে মানুষ স্ত্রী, পুত্র, ধন, মিত্র প্রভৃতি সাকার পদার্থে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু নিরাকারে যুক্ত না করা পর্যন্ত কারো মন স্থির হয় না। মন নিরবয়ব বলে নিরাকারে স্থির হয়ে যায়।

অতএব, এক – মূর্তিপূজা করা অধর্ম।

দুই – মূর্তিপূজা উপলক্ষ্যে লোকেরা মন্দিরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দরিদ্র হয়ে পড়ে এবং মন্দিরে প্রমাদ ঘটে।

তিন – মন্দিরে স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশা হয়। তাতে ব্যভিচার, কলহ-বিবাদ, রোগ ইত্যাদি উৎপন্ন হয়।

চার – মূর্তিপূজাকেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সাধন মনে করে লোকেরা পৌরুষরহিত হয় এবং বৃথা মানবজন্ম নষ্ট করে।

পাঁচ – বিবিধপ্রকার বিরুদ্ধস্বরূপ, নাম, চরিত্র ইত্যাদিবিশিষ্ট মূর্তিসমূহের কারণে পূজারীদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট হয়। ফলে তারা বিরুদ্ধমতে চলে এবং পরস্পরের মধ্যে ভেদবৃদ্ধি সৃষ্টি করে দেশের সর্বনাশ করে।

ছয় – মূর্তিপূজার ভরসায় শত্রুর পরাজয় এবং নিজের বিজয় মনে করে মূর্তিপূজক নিশ্চেষ্ট থাকে। ফলে নিজের পরাজয় হলে রাজ্য, স্বাতন্ত্র এবং ঐশ্বর্যসুখ শত্রুর অধীনে চলে যায় এবং স্বয়ং পরাধীন হয়ে সরাইরক্ষকের টাট্টু এবং কুম্ভকারের গর্দভের ন্যায় শত্রুর বশীভূত হয়ে বহুবিধ দুঃখ প্রাপ্ত হয়।

সাত – যদি কেহ কাহাকেও বলে, ‘আমি তোমার উপবেশনের আসন বা নামের উপর পাথর চাপা দিচ্ছি’, তখন সে যেমন ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে প্রহার করে অথবা কটু কথা বলে, সেরূপ যারা পরমেশ্বরের উপাসনা-স্থান, হৃদয় এবং নামের উপর পাষাণাদি মূর্তি স্থাপন করে, পরমেশ্বর সেই দুর্বুদ্ধিদের সর্বনাশ করবেন না কেন?

আট – লোকেরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে মন্দিরে মন্দিরে, দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করতে করতে কষ্টভোগ করে, ধর্ম, সংসার এবং পারমার্থিক কার্য নষ্ট করে, চোর প্রভৃতি দিয়ে উৎপীড়িত হয় এবং প্রতারকদের দিয়ে প্রতারিত হতে থাকে।

নয় – দুষ্টবুদ্ধি পূজারীদেরকে যে ধন দেওয়া হয়, তা তারা বেশ্যা বা পরস্ত্রীগমন, মদ্যপান, মাংসাহার এবং কলহ-বিবাদে ব্যয় করে। তাতে সুখের মূল নষ্ট হয়ে দুঃখ সৃষ্টি করে।

দশ – মাতাপিতা প্রমুখ মাননীয়দের অপমান এবং পাষাণাদি মূর্তির সম্মান করে মানুষ কৃতঘ্ন হয়ে পড়ে।

এগারো – যখন কেহ সেই মূর্তিগুলি ভেঙে ফেলে কিংবা চোর অপহরণ করে, তখন মূর্তিপূজক ‘হায়! হায়!’ করে কাঁদতে থাকে।

বারো – পূজারীরা পরস্ত্রী এবং পূজারিণীরা পরপুরুষদের সঙ্গবশতঃ প্রায়ই কলুষিত হয়ে দাম্পত্য প্রেমের আনন্দ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়।

তেরো – প্রভু এবং ভৃত্যের মধ্যে যথোচিত আজ্ঞা পালন না হওয়াতে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

চৌদ্দ – যারা জড়পদার্থের ধ্যান করে, তাদের আত্মাও জড়বুদ্ধি হয়। কারণ ধ্যেয়র জড়ত্ব-ধর্ম অন্তঃকরণ দিয়ে অবশ্য আত্মায় সঞ্চারিত হয়।

পনেরো – পরমেশ্বর জলবায়ুর দুর্গন্ধ নিবারণ এবং আরোগ্যের জন্য পুষ্পাদি সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু পূজারিরা তা তুলে নষ্ট করে। কে জানে, এসব পুষ্পের সুগন্ধ আকাশে বিস্তৃত হয়ে কতদিন পর্যন্ত জলবায়ু শুদ্ধ করতো! পূর্ণ সুগন্ধ বিস্তৃত হওয়ার সময় পর্যন্ত এসবের সুগন্ধ থাকতো। পূজারিরা কিন্তু মাঝখানে তা নষ্ট করে দেয়। পুষ্পাদি কাঁদার সাথে মিশে, পচে বিপরীত দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। প্রস্তরের উপরে অর্পণ করার জন্যই কি পরমাত্মা পুষ্পাদি সুগন্ধদ্রব্য সৃষ্টি করেছেন?

ষোল – পাথরের উপর অর্পিত পুষ্প-চন্দন, আতপ প্রভৃতি জল ও মৃত্তিকার সাথে সংযুক্ত হয়ে ক্রমশঃ নর্দমা অথবা কুণ্ডের মধ্যে এসে পচে যাওয়ার পর, তাথেকে পুরীষ-গন্ধের মতো দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং সহস্র জীব সেই নর্দমা অথবা কুণ্ডের মধ্যে পড়ে মরে পচতে থাকে।

মূর্তিপূজায় এরূপ অনেক দোষ আছে। তাই খড়কুটা-মাটি-পাথরের মূর্তিপূজা সজ্জন ব্যক্তিদের পক্ষে সকল প্রকারে পরিত্যজ্য। যারা মূর্তিপূজা করেছেন, করেন এবং করবেন, তারা পূর্বোক্ত দোষাবলি থেকে রক্ষা পান নাই, পাচ্ছেন না এবং পাবেনও না।

লেখক : ‘আর্যসমাজের’ প্রতিষ্ঠাতা

রচনাটি লেখকের ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ থেকে সংকলিত। সংস্কৃতপ্রভাবিত সাধুরীতির বাংলা অনুবাদকে চলিত করা হয়েছে।

 20,859 total views,  17 views today


মন্তব্য (০ টি)

মন্তব্য করুন