বৌদ্ধধর্মের পরিচয়

আনসার-উল-হক ।।

বৌদ্ধধর্ম গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত একটি জীবনব্যাখ্যা। অনুসারীদের সংখ্যায় বৌদ্ধধর্ম বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর-পূর্ব ভারতের কপিলাবস্তুতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম।

অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের মতো বুদ্ধের বাণীও প্রাথমিকভাবে মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে এসেছে। কারণ, সেইসময়ে কারো বাণী লিপিবদ্ধ করে রাখার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার বিশেষ অভাব ছিল। বুদ্ধের বাণীগুলো তাই তার শিষ্যদের বংশপরম্পরায় মুখে মুখে রক্ষিত হয়ে এসেছিল। তবে বর্তমানে আমরা তাঁর বাণীগুলো বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিটকের’ মধ্যে পাই।

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক

‘ত্রিপিটক’ কথার অর্থ হলো তিনটি ঝুড়ি। এর প্রথমটি হলো ‘বিনয়পিটক’, দ্বিতীয়টি ‘সুত্তপিটক’ এবং তৃতীয়টি ‘অভিধম্মপিটক’। এগুলো সংগৃহীত এবং বুদ্ধের শিষ্যদের দ্বারা পরিশীলিত (Canonical); অর্থাৎ এর মধ্যে শিষ্যদের নিজস্ব মতামত ও চিন্তাধারার প্রক্ষেপণ রয়েছে এবং থাকাটা একান্তই স্বাভাবিক।

যাই হোক, বিনয়পিটকে সংঘের নিয়মকানুন ও পরিচালনপদ্ধতি, সুত্তপিটকে বুদ্ধের উপদেশ ও পারস্পরিক কথাবার্তা এবং অভিধম্মপিটকে বুদ্ধের মতবাদের দার্শনিক বিশ্লেষণ ও মতবাদসমূহ স্থানলাভ করেছে। এর সবই ‘পালি’ ভাষায় লিখিত। তবে বৌদ্ধধর্মের পরবর্তীকালের দার্শনিক মতবাদগুলো সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের বিস্তার এবং বিভিন্নতা

সময়ের সাথে সাথে বৌদ্ধধর্ম যখন বিভিন্ন রাজ-রাজড়াদের আনুকূল্য লাভ করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই ধর্মমতের মধ্যে বহু পরিবর্তন ও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলো। অন্যদিকে হিন্দুধর্মের প্রবল বিরোধিতা, আগ্রাসন ও নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে ধর্মটি এর উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় নির্মূল হয়ে গেলেও সিংহল, বার্মা, ইন্দোচীন, তিব্বত, চীন ও জাপানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুলসংখ্যক অনুসারী লাভ করে। স্বাভাবিকভাবে এরমধ্যে প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক কৃষ্টি ও নিজস্ব মননশীলতা এবং বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ এতে এমনভাবে মিশ্রিত হয়েছে যে এগুলোকে সামগ্রিকভাবে একত্রিত করা, বিশ্লেষণ ও সংক্ষেপকরণ এক দুরূহ ব্যাপার।

ধর্ম হিসেবে আজ আমরা যে বৌদ্ধধর্মকে পাচ্ছি, তার মোটামুটি বিশ্লেষণ করলে এরমধ্যে আমরা ২টি মূলধারাকে দেখতে পাবো; যার একটি হলো থেরবাদ বা হীনযান, আর অপরটি মহাযান মতবাদ।

জগত-জীবন নিয়ে বৌদ্ধ ভাবনা

বুদ্ধ মূলত একজন নৈতিক শিক্ষক হিসেবে তাঁর ধর্মমতকে প্রচার করেছিলেন। তিনি নিজে দার্শনিক ছিলেন না। দর্শনের বিভিন্ন প্রশ্নাবলী আলোচনা করতেও তিনি অনীহা প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, মানুষ দারুণ অশান্তি ও দুঃখকষ্টে জীবনযাপন করছে। এই দুঃখের অবসান ঘটিয়ে চাই ‘নির্বাণ’। মানুষের বুকে যেন একটি তীর বিঁধে রয়েছে। সেই তীরটিকে সরানো প্রয়োজন। তীরটি কী দিয়ে তৈরী, কোত্থেকে এলো, এসব প্রশ্ন জীবনের মুখ্য প্রয়োজন নয়। মানুষের মুখ্য প্রয়োজন হলো কিভাবে যাপিত জীবনের দুঃখকষ্ট ও অশান্তি থেকে বাঁচা যায়, তার চেষ্টা করা।

নির্বাণ

বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হলো ‘অরাহত’, ‘বিমুত্তি’ বা ‘নির্বাণ’ অবস্থা অর্জন করা।

বুদ্ধের মতে, বাসনা হলো যাবতীয় দুঃখের মূল। তাই সর্বপ্রকার বাসনার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। আর বাসনার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে নির্বাণ। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া (দীপনির্বাণ, নির্বাণোন্মুখ প্রদীপ), বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান। কিন্তু বৌদ্ধমতে নির্বাণ হলো সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ। সাধনার সাহায্যে ঐ অবস্থা অর্জন করা সম্ভব।

বৌদ্ধধর্ম বলে, বৃথা সময় নষ্ট না করে, প্রত্যেকেরই উচিত বুদ্ধ-নির্দেশিত পথে অগ্রসর হয়ে, অরাহত অবস্থা অর্জন করে, জাগতিক সমস্ত দুঃখকষ্ট ও কামনা-বাসনা-শূন্য অবস্থায় পৌঁছে জীবনের পূর্ণতা অর্জন করা।

জীবনের মূলসত্য

বৌদ্ধধর্ম অনুসারে জীবনের চারটি মূলসত্য হলো :

১. জাগতিক জীবন দুঃখকষ্টে ভরা।
২. এই দুঃখকষ্ট ভোগ করার কারণ রয়েছে।
৩. জীবনের এই দুঃখভোগ থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব।
৪. এই দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তির একটি বিশেষ পথ রয়েছে। (দুঃখ-সমুদয়, দুঃখ-নিরোধ, দুঃখ-নিরোধ-মার্গ)।

বুদ্ধের সমস্ত শিক্ষা এই চারসত্যকে ঘিরে।

দুঃখকষ্টের কারণ

বৌদ্ধধর্ম অনুসারে দুঃখকষ্টের বারোটি কার্যকারণ সংযুক্তি রয়েছে, যেসবের একটি আরেকটির কারণে উদ্ভূত। সংযুক্তিগুলো-

১. জীবনে দুঃখকষ্ট রয়েছে; এর কারণ হলো- ২. পৃথিবীতে জন্ম; এর কারণ হলো- ৩. জন্মের আকাঙ্ক্ষা; এর কারণ হলো- ৪. পার্থিব বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি মানসিক আসক্তি; এর কারণ হলো- ৫. ঐসব পার্থিব বস্তু লাভের আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা; এর কারণ হলো- ৬. সেসব জিনিষের সাহায্যে আরাম-আয়েশ লাভ করা যাবে, এমন ধারণা; এর কারণ হলো- ৭. বস্তুগুলোর সাথে ইন্দ্রিয়ের যোগাযোগ; এর কারণ হলো- ৮. ষড় ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তু বিষয়ক জ্ঞানলাভ; ষড় ইন্দ্রিয়ের উৎপত্তিগত কারণ হলো- ৯. জন্মকালীন ভ্রুণ, যার মধ্যে শরীর ও মন প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে; যার গঠনের মূল কারণ হলো- ১০. প্রাথমিক সচেতনতা; যার কারণ হলো- ১১. পূর্বজন্মের বিভিন্ন কর্মের ফলাফল ও তার প্রভাব; যার কারণ হলো- ১২. সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞানতা। এই হলো দ্বাদশ নিদান।

অতএব বৌদ্ধধর্ম অনুসারে দেখা যায় – বর্তমান জীবন হলো এক পূর্বজন্মের প্রতিফল এবং ভবিষ্যতজন্মের কারণ।

বুদ্ধের মতানুসারে জীবনের দুঃখকষ্ট, বেদনা-যাতনা দূর করা সম্ভব, এর কারণটিকে দূরীভূত করে; এবং তা এই জীবনের কর্মের মাধ্যমেই সম্ভব।

মুক্তির উপায়

বৌদ্ধধর্ম অনুসারে মুক্তির উপায় অষ্টাঙ্গিক মার্গপথ অবলম্বন, অর্থাৎ আটটি বিশেষ প্রক্রিয়া সাধন। যথা:

১. সম্যক দৃষ্টি, ২. সম্যক সংকল্প, ৩. সম্যক বাক্য, ৪. সম্যক কর্ম, ৫. সম্যক জীবনযাপন, ৬. সম্যক প্রচেষ্টা, ৭. সম্যক স্মৃতি, ৮. সম্যক সমাধি (ধ্যান)।

এই অষ্টাঙ্গিক মার্গপথে প্রধান ৩টি বিষয় রয়েছে; তা হলো: ১. ব্যবহার (শীল), ২. কেন্দ্রীভূত মনোযোগ (সমাধি) এবং ৩. জ্ঞান (প্রজ্ঞা)।

শেষকথা

আদি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো যে, এটি মূর্তিপূজার ধর্ম নয়; বরং এতে সৎকর্মভিত্তিক এমন একটি জীবনব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যা অবলম্বন করে মানুষ তার মনুষ্যত্বের চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছতে পারে।

তবে বুদ্ধ যে জীবনব্যবস্থার দীক্ষা দিয়ে গেছেন, তা সাধারণ মানুষের জন্য মেনে চলা বা সেইপথ অবলম্বন করা খুবই কঠিন।

বুদ্ধের শেষ বাণী হলো, “নিজের কাজে আলোকের মতো প্রদীপ্ত হও। ক্ষয়প্রাপ্তিই প্রতিটি জিনিসের অন্তর্নিহিত গুণ। মুক্তির পথে তাই অধ্যবসায়ের সঙ্গে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও। এইপথ অবলম্বন করা বীরের কর্ম, যাদের সংখ্যা পৃথিবীতে খুবই অল্প।”

 19,272 total views,  2 views today


মন্তব্য (২ টি)

  • Ansarul Haque বলেছেন,

    সম্পাদক সাহেব, আমার লেখার শেষ অংশটা কৈ ? শেষ অংশে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থে রাসুল ই কারিমের কথা উল্লেখ রয়েছে তার বিবরণ এবং ধর্মাবলম্বীদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে তার কোন অংশই তো লেখাটার মধ্যে দেখছি না !!! ব্যাপার কি ?

    অক্টোবর ২০, ২০২০, ৪:১৬ পূর্বাহ্ন

রিপ্লাই করুন @ Ansarul Haque , রিপ্লাই বাতিল করুন