আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের গুণাবলি অর্জন করা জরুরি

মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী ।।

দাওয়াত যেহেতু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের কাজ, তাই দা’ঈদের জন্যও ওইসব গুণাবলি অর্জন করা জরুরি, যেগুলো হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মাঝে বিদ্যমান ছিল। যার মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি।

এ ছাড়া আখলাকে হাসানা বা উত্তম চরিত্র নিজের জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে এমনভাবে অবলম্বন করতে হবে, যাতে আমার জীবনের প্রতিটি বিষয় উত্তম আদর্শের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এবং আমার প্রতিটি বিষয় উত্তম আদর্শের ছাঁচে তৈরি হয়। কারণ মানুষ জবানের ওয়াজ-নসীহতে ততটা প্রভাবিত হয় না, যতটা বাস্তব আমলী দাওয়াতের মাধ্যমে হয়। আজকের অমুসলিমরা ইসলামী শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে তো মুসলমান হচ্ছে, কিন্তু মুসলিমদের জীবনযাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হচ্ছে না; বরং তার প্রতি উল্টো তাদের অন্তরে ঘৃণার জন্ম নিচ্ছে। কারণ ব্যাপকভাবে আজ মুসলমানদের জীবনযাপন ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। এ বিষয়ে এক শিখের ঘটনা মনে পড়ল।

আমি একবার জার্মানি গিয়েছিলাম। ফেরার আগে হাতে কিছু সময় ছিল। বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রবেশ করলাম। যার মালিক ছিল এক শিখ ধর্মাবলম্বী। সে খুব হাসিখুশি এসে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করল এবং আমরা পাকিস্তানের বাসিন্দা এ কথা শুনে অনেক খুশি প্রকাশ করল। সে খুব বিশুদ্ধ ও মাধুর্যপূর্ণ উর্দু ভাষায় বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, কেনাকাটা শেষ করে যদি সামান্য সময়ের জন্য একটু আমাদের অফিসে আসেন, তাহলে বড় মেহেরবানি হবে। আমি ওয়াদা করলাম।

কিন্তু কেনাকাটা সারতে কিছুটা বিলম্ব হয়ে গেল। এরই মাঝে তার কাছ থেকে দুইতিনবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পয়গাম এল, যেন ভুলে না যাই। কেনাকাটা শেষ করে তার অফিসে গেলাম। অফিসটি মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। প্রতিটি বস্তু খুব সুরুচি ও বিচক্ষণতার সঙ্গে জায়গামতো রাখা। তার এই সুরুচি ও আভিজাত্যবোধ আমার খুব ভালো লাগল।

এবার তার সঙ্গে কথা শুরু হলো। প্রথমে সে ইসলামী আকিদা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করল। আমি তাকে বিস্তারিতভাবে উত্তর দিলাম। দীর্ঘ আলাপচারিতার পর সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ইসলাম কীভাবে গ্রহণ করতে হয়? আমি বললাম, ইসলাম গ্রহণ করা তো খুবই সহজ। ইসলামের একটি কালিমা আছে, সেটি পড়তে হবে এবং তার অর্থ ও মর্ম বুঝে পূর্ণ বিশ্বাস করে, মনেপ্রাণে তা মেনে নিতে হবে। সে বলল, ঠিক আছে; তাহলে সে কালিমাটি আমাকে পড়িয়ে দিন। আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। আমি তাকে কালিমা পড়িয়ে দিলাম এবং কালিমার অর্থ বুঝিয়ে দিলাম। সে বলল, আমি তা মেনে নিলাম।

তারপর আমি তাকে বললাম, এবার আপনি আমাদের সঙ্গে দু’আ করুন। কারণ, এখন আপনার দু’আ বেশি কবুল হবে। আমি তাকে হাদীস শোনালাম যে, ইসলাম গ্রহণ করলে আল্লাহ্‌ অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। এরপর আমরা তার সঙ্গে খুব দু’আ করলাম।

দু’আ শেষে আমি তাকে বললাম, আপনাকে মোবারকবাদ, এই মুহূর্তে আপনি হলেন আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মুসলিম ব্যক্তি, কারণ আপনার অতীত-জীবনের গুনাহগুলো সব আল্লাহ্‌ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনার বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়; মাশাআল্লাহ আপনি আল্লাহ্‌র মেহেরবানিতে মুসলমান হয়ে গেছেন।

হঠাৎ সে চমকে উঠে বলতে লাগলো, কী-আমি মুসলমান হয়ে গেছি! বললাম হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ আপনি মুসলমান হয়ে গেছেন। সে পেরেশান হয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, না; আমি মুসলমান হব না। আমি খুব পেরেশান হলাম; বললাম, এখনই তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, আবার এখন বলছেন আমি মুসলমান হব না! আসলে কী বলতে চান একটু খুলে বলুন তো!

সে বলল, আপনি ইসলাম সম্পর্কে যা যা বলেছেন সবই আমি মানি, তবে মুসলমান ভালো না। তারপর সে বলল, ভারত ভাগের আগে আমরা শিয়ালকোটে বাস করতাম। আমাদের অনেক জায়গা-জমি, সহায়-সম্পদ ছিল। ভারত বিভক্তির সময় মা, বাবা, ভাই, বোন সবাই মিলে আমরা ভ্রমণে বের হয়েছিলাম। কিন্তু বিভক্তির ঘোষণা হওয়ার পর রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল এবং আমাদের সবকিছু পাকিস্তানে রয়ে গেল। তারপর আমরা দিল্লি চলে এলাম, বাবা সেখানেই কাজ করতে লাগলেন আর আমি জার্মানি চলে এলাম।

যা হোক, এরপর আমি তাকে বোঝালাম এবং সেও বুঝল। তারপর সে জানতে চাইল; এখন আমার করণীয় কী? বললাম, ইসলাম গ্রহণ করার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান দায়িত্ব হলো নামায। তাকে নামায সম্পর্কে জানালাম। ততক্ষণে আসরের নামাযের সময় হয়ে গেল এবং আমরা সেখানেই তাকে নিয়ে নামায আদায় করলাম।

আমাদের হাতে যেহেতু সময় কম ছিল, তাই আমাদের মেজবানকে বললাম, পড়ার জন্য তাকে দীনের মৌলিক কিতাবাদি ব্যবস্থা করে দেবেন। আমার ফোন নম্বরও দিয়ে দিলাম।

পরে যখন আমি আবার জার্মানি গেলাম, তখন আমার মেজবান বললেন, ওই লোক তো অসুস্থ; হাসপাতালে আছেন। তার পক্ষ থেকে সংবাদ এসেছে, আপনি যেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান। যেহেতু আমাদের হাতে একদম সময় ছিল না এবং অবস্থানও ছিল একটু দূরে, যার ফলে সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না, এ জন্য তাকে বললাম, ফোনের লাইন লাগিয়ে দিন। কিন্তু ফোনেও চেষ্টা করে লাইন পাওয়া গেল না। আমি চলে এলাম। দেশে এসে জানতে পারলাম তার ইন্তেকাল হয়ে গেছে।

এই ঘটনা শোনানোর উদ্দেশ্য হলো, আমাদের মধ্যে সেই জীবন ও জীবনাচার নেই, যা আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিল। যার কারণে মানুষ এখন মুসলমানদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে বীতশ্রদ্ধ।

এই জন্য আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো, নিজেদের মধ্যে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সেসব গুণাবলি তৈরি করা।

অনুবাদ : মুফতি মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ

 10,527 total views,  3 views today


মন্তব্য (০ টি)

মন্তব্য করুন