কাদিয়ানি ধর্ম : সূচনা ও প্রচারণা

আবু জর ।।

কাদিয়ানিদের শঠতা আর ভুলে কানায় কানায় পূর্ণ এই ধর্মের প্রবর্তন ঘটে আঠার শতকের শেষের দিকে। আজ থেকে প্রায় দেড় শত বছর আগের ইতিহাস। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার হাত থেকে ক্ষমতা যখন ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয় এটি তারও বেশ কিছু পরের কথা৷

সুচতুর ইংরেজ মুসলমানদের হাত থেকে অখণ্ড ভারতের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। প্রায় ১৯০ বছর পর্যন্ত তারা ভারতীয়দের গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তারা স্বস্তিতে দেশ পরিচালনায় অপারগ ছিল। কারন স্বাধীনতাকামী মুসলিম বিপ্লবীরা আযাদী আন্দোলনে আপোষহীন ছিলেন। স্বাধীনচেতা রক্ত টগবগে বিপ্লবী মুজাহিদদের তখন কোনো মতেই দমন করা যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় দখলদার ইংরেজ সরকারের পক্ষে নিজেদের ক্ষমতা টিকানো ছিল খুবই দুরূহ ব্যাপার। তাই তারা মুসলিম মুজাহিদদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে ফাটল ধরানোর কৌশল খুঁজতে লাগল। ধূর্ত ইংরেজ কৌশল খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে পড়ল। অবশেষে তারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলার ষড়যন্ত্রই পাকাপোক্ত করল। বেছে নিল অতি কুটিল এক পন্থা৷ তাদেরই পরীক্ষিত ও প্রশিক্ষিত অনুগত এক ব্যক্তিকে “নবী” হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার ফন্দি আটঁল। আর এ ভয়ংকর পন্থায় নবীর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তাদের পদলেহি এক গোলামকে। পরিবার থেকে একজন গোলামকে বেছে নেয়া হল তাদের পদলেহী এক গোলামকে। এই গোলামই কাদিয়ানী ইজমের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী।

১৮৩৮ সালে মির্জা গোলাম আহমদের জন্ম। তৎকালীন ভারতের (বর্তমান পাকিস্তানের) পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার “কাদিয়ান” নামক গ্রামের বাসিন্দা। তাকে মির্জা কাদিয়ানী বলা হত। বর্তমানে তার অনুসারিদেরকে “কাদিয়ানী বা আহমদি” বলা হয়ে থাকে।

গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইংরেজদের শেখানো বুলি ও তাদের নির্দেশনা মত প্রথমে সরলমনা মুসলমানদের নিকট নিজেকে “মুজাদ্দিদ” হিসেবে জাহির করেন। তার দাবির ফিরিস্তি অনেক লম্বা। নিজেকে “খোদা” থেকে শুরু করে আর্যজাতির “রাধাকৃষ্ণ” হবার দাবি পর্যন্ত তার বইতে উল্লেখ আছে।

১৮৬৪ সাল থেকে ইলহামের দাবিদার তিনি। ১৮৮৪ সালে নিজেকে মুজাদ্দিদ দাবি করেন। তখন “বারাহিনে আহমদিয়া” নাম দিয়ে একটি বইও লিখেন। এভাবে ১০ বছর অতিবাহিত হয় তার মুজাদ্দিদ দাবির মধ্য দিয়ে। তারপর তিনি ১৮৯০ সালে প্রথমে ইমাম মাহাদী, এর কিছুদিন পরে ঈসা মাসীহ (আ)-এর “মাসীল” বা রূপক হওয়ার দাবি করেন। তখন নতুন করে তিনি কুরান শরিফ থেকে হযরত ঈসা (আ)-এর মৃত্যুর ভুল তথ্য আবিষ্কার করে মানুষকে ধোকা দিতে শুরু করেন।

১৯০১ সালে নিজেকে কথিত “উম্মতি নবী” দাবি করেন। তারপর ১৯০৭ সালে আর কোনো রাখঢাক ছারাই নিজেকে পরিপূর্ণ একজন নবী এবং রাসূল ঘোষণা দিয়ে বসেন। নবী ঘোষণা দেয়ার পরই তার আসল চেহারা বের হয়ে আসে। এত দীর্ঘ সময় যেই ফতোয়ার অপেক্ষায় ছিল দখলদার সুচতুর ইংরেজগোষ্ঠী। মির্যা সাহেব যেহেতু আল্লাহ’র একজন প্রেরিত নবী সেহেতু আল্লাহ’র নাম ভেঙ্গে এখন আর কোনো কিছু প্রচারে বাধা থাকল না। তাই তিনি ফতুয়া জারি করলেন, “বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহতালা বলেছেন, এদেশে ব্রিটিশ শাসন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে মনোনীত। তাদের অত্যাচার অবিচার যাই দেখনা কেন, তা আল্লাহ’র রহমত এবং আশীর্বাদ। তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম।”

আলেম সমাজ মির্যা কাদিয়ানিকে প্রথম থেকেই সন্দেহের চোখে দেখে আসছিলেন। এবার যখন তিনি স্ব মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করলেন তখন তাদের সেই সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হল। তারা তখন তার বিরোধিতা শুরু করেন৷ কিন্তু মির্জা কাদিয়ানি ছিল অত্যন্ত ধুরন্ধর এক ব্যক্তি। সব সময় রাষ্ট্রক্ষমতাকে পুঁজি করে চলা ছিল তার নীতি। আলেমদের সঙ্গে সম্মুখ বিতর্কে পরাজিত হলেও ইংরেজ শাসকদের আশির্বাদে তাকে কখনই চূড়ান্তরূপে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

কাদিয়ানিদের মৌলিক তৎপরতার অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে অপপ্রচার। ইসলামের বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করে এবং ইসলামের নাম ভাঙিয়ে দরিদ্র ও সাধারণ মুসলমানদের তারা বিভ্রান্ত করে থাকে।

‘তাদের বেশ কিছু সংগঠন আছে, সংগঠনগুলো প্রশিক্ষিত কর্মী দ্বারা গঠিত, এদেরকে তারা ‘মুবাল্লিগ’ বলে, এই মুবাল্লিগদেরকে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পাঠিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা থেকে দূরে থাকা সরলমনা সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার কাজ আঞ্জাম দেওয়া হয়। কেবল যে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এই কাজ সীমাবদ্ধ, এমন না, উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবীদেরকেও তারা নানাভাবে বিভ্রান্ত করে।

‘মাসিক আহমদী নামে একটা পত্রিকা আছে তাদের, ওটা দ্বারা মূলত শিক্ষিত সমাজকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া ‘মসজিদ’ নাম দিয়ে তাদের যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতেও দাওয়াতের নামে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা সেমিনারের।

‘সারাদেশে কাদিয়ানিদের চারশো পঁচিশটির মতো শাখা আছে, দেশের নানাপ্রান্তের গ্রাম এবং শহরকে কেন্দ্র করে গঠন করা হয়েছে এসব শাখা। মূলত এগুলোর তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয় তাদের আঞ্চলিক যাবতীয় তৎপরতা।

‘সাধারণ মুসলমানদের খুব কৌশলে তারা ধোঁকা দেয়। বলে, আপনারা মুসলমান, আমরাও মুসলমান, কোনো তফাত নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আপনারা যেমন নবি ও রাসুল মানেন, বিশ্বাস করেন—আমরাও তাই। তাঁর সঙ্গে আপনি কেবল আমাদের নবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানিকেও নবি মেনে নিন, ব্যস, আপনি আমাদের ভাই হয়ে যাবেন। এভাবেই নম্র ও আপোসকামী মোলায়েম ভাষায় সাধারণ মুসলমানদের মগজ ধোলাই করে তারা বিভ্রান্ত করে। পাশাপাশি ভালো মাইনের চাকরি এবং আর্থিক লোভও দেখায়। ফলে মানুষ সহজেই তাদের শিকারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা নিরলস তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরাতে বেশ কিছু গ্রাম মিলিয়ে বিশাল সংখ্যক অনুসারী তারা তৈরি করেছে। প্রতিবছর কাদিয়ানীরা সেখানে ‘সালানা জলসা’র আয়োজন করে। সেখানে কাদিয়ানীদের পাশাপাশি স্থানীয় মুসলমানদেরকেও সমানভাবে দাওয়াত করে। উন্নত মানের খাবার-দাবারের আয়োজন করে। খাবার পর্বের আগে বা পরে কেন্দ্রীয় কোনো ব্যক্তি তাদের সামনে এ ধর্মমতের উপর আলোচনা করে। কোরআন হাদীস এর মিথ্যা উদ্ধৃতিতেই তারা কথা বলে। কথায় কথায় কোরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস মানুষকে শোনায়। নিঃসন্দেহে তাদের এ আলোচনা পর্বই এ মহা আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য। যেখানকার মানুষ দ্বীনী শিক্ষা থেকে প্রায় বঞ্চিত তাদের সামনে কোরআনে আয়াতের অপব্যাখ্যা করতে ও হাদীসের অপপ্রয়োগ করতে তাদের কোনো ধরণের অসুবিধা হওয়া কথা না।

এভাবে পার্বত্য ও দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে মিশনারী কায়দায় এবং অন্যান্য জায়গায় উপযুক্ত কৌশল ও প্রলোভনের আশ্রয় নিয়ে তারা প্রতিনিয়ত তাদের পালা ভারী করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের বড় বড় বেশ ক’টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং বহির্বিশ্বের শক্তিশালী কাদিয়ানি সংগঠনগুলো মদদ দিচ্ছে এখানে। এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল নেতৃত্বের ভালো রকমের সম্পর্ক আছে। যার দরুণ ক্ষমতার পালাবদল হলেও সব সরকারই কাদিয়ানিদেরকে প্রটেকশন দিতে অনেকটা বাধ্য। বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামও তাদের একবিন্দু ছাড় দিতে প্রস্তুত নন। তবে রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত জটিলতার কারণে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার প্রকল্পটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আন্দোলন আরও জোরদার হলে এদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব বলে আশা করা যায়।

সৌজন্যে : fateh24.com, মে ২৬, ২০১৯

ছবি ১ : মির্জা গোলাম আহমদ এবং তার কিছু সঙ্গী, কাদিয়ান, ১৮৯৯
(উইকিপিডিয়া’র সৌজন্যে)

ছবি ২ : বাংলাদেশের বিভিন্ন কওমি মাদরাসায় পাঠানো কাদিয়ানি চিঠি, যাতে গোলাম আহমদকে একইসঙ্গে ‘২য় মুহাম্মাদ’ এবং ‘ইমাম মাহদী’ বলে দাবি করা হয়েছে, ২০২০


মন্তব্য (০ টি)

মন্তব্য করুন