কোয়ান্টাম মেথড : কী বিশ্লেষণ ইসলামের

মুফতী মনসূরুল হক ।।

কোয়ান্টাম মেথডের কোর্সে ভর্তির পর সর্বপ্রথম একটি প্রত্যয়ন পাঠ করা হয়, এই প্রত্যয়নই তাদের মূল চালিকাশক্তি। প্রত্যয়নটি এই, ‘অসীম শক্তির অধিকারী আমার মন, যা চাই তাই পাবো যা খুশি তাই নেব।’ তাদের এই প্রত্যয়নটি সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। কেননা কুরআনের অনেক আয়াত আর অনেক হাদীস দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই অসীম শক্তির অধিকারী। তিনি ছাড়া আসমান-যমীনে যা কিছু আছে সবকিছুর শক্তিই সসীম। অতএব মানুষের মনকে অসীম শক্তির অধিকারী বলা স্পষ্ট কুফরী কথা।

তাছাড়া ‘যা চাই তাই পাবো’ এই বিশ্বাসে আল্লাহর উপর ভরসার হুকুম স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। কুরআন শরীফে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে যেকোনো কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করতে বলেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “অতঃপর আপনি যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯, আরো দ্রষ্টব্য, সূরা তাওবা : ৫১, সূরা তাগাবুন : ১৩, সূরা ইউসুফ : ৬৭, সূরা আল ফুরকান : ৫৮ ইত্যাদি) অথচ কোয়ান্টামের এই কথা ‘যা চাই তাই পাবো’ এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। হ্যাঁ তারা যদি কথাটা এভাবে বলতো, ‘যা চাই তাই পাবো, যদি আল্লাহ চান’ তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না।

২. ‘যা চাই তাই পাবো’ এখন প্রশ্ন হলো দিবে কে? এই প্রশ্নের জবাব কোয়ান্টাম কণিকা ২৩৯ পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, “কোয়ান্টামের মতে আল্লাহ/গড/ ভগবান/ প্রকৃতি যে কেউ দাতা হতে পারে।” অথচ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রকৃত দাতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। গড/প্রকৃতি/ভগবান এসবকে দাতা মানার অর্থই হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যকে শরীক করা। আর শিরক দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। অতএব কোয়ান্টামের এই মতবাদ সম্পূর্ণ ঈমানবিধ্বংসী মতবাদ।

তাছাড়া ‘যা চাই তাই পাবো’ একথা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ চাওয়ার সাথে পাওয়ার শতভাগ সংযোগ হবে জান্নাতে। এই পৃথিবীতে শতভাগ চাওয়া পাওয়ায় পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন ‘মানুষ যা চায় তাই কি পায়?’ (সূরা আন নাজাম : ২৪) যদি পৃথিবীতেই মানুষের শতভাগ চাওয়া পাওয়ায় রূপান্তরিত হতো, তাহলে তো পৃথিবীই জান্নাত হয়ে যেতো। মানুষের শতভাগ চাওয়া তথা আশা-আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র জান্নাতেই পুরা করা হবে, এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর তোমরা সেখানে যা চাবে তাই পাবে।” (সূরা হামীম সেজদা : ৩১)

৩. কোয়ান্টামের মতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলাম মোটকথা সব ধর্মের মৌলিক শিক্ষাই এক। কাজেই যেকোনো ধর্ম পালনই যথেষ্ট। কোয়ান্টামের মতে সকল ধর্মই গ্রহণযোগ্য। (কোয়ান্টাম উচ্ছ্বাস, পৃ.৯)

ইসলামে পূর্বের সকল নবী-রাসূল ও আসমানী গ্রন্থসমূহকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এই স্বীকৃতির অর্থ এই নয় যে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরও যদি কেউ নিজ ধর্ম অনুযায়ী আমল করে, তাহলে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। বরং এই স্বীকৃতির অর্থ এই যে, পূর্বের নবী-রাসূলগণ বাস্তবেই সত্য নবী-রাসূল ছিলেন এবং তাদের যমানায় তাদের কিতাবও সত্য ছিল। কিন্তু কুরআন অবতীর্ণ হওয়ায় পূর্বের সমস্ত আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গেছে। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট ভাষায় কুরআনে বলে দিয়েছেন “যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পালন করবে, কস্মিনকালেও তা তার থেকে গ্রহণ করা হবে না, আর আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)

যেখানে কুরআনে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হলো, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়, সেখানে কোয়ান্টাম মেথড কিভাবে অন্য ধর্মকেও গ্রহণযোগ্যতার সনদ দিতে পারে? কোয়ান্টামের কী অধিকার আছে যে সে অন্য ধর্মকে গ্রহণযোগ্যতার সনদ দিবে? একই সময়ে একাধিক ধর্মকে গ্রহণযোগ্য বলা যুক্তিবিরুদ্ধ কথাও বটে। কেননা ধর্ম হলো মানুষের জীবনযাপনের আসমানী সংবিধান। একই দেশে একই সময়ে একাধিক সংবিধান যেমন কার্যকর নয়, তেমনিভাবে আল্লাহর এই পৃথিবীতে একই সময়ে একাধিক ধর্ম বা সংবিধান কার্যকর হওয়া বা গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব নয়। ইসলাম যেহেতু সর্বশেষ আসমানী সংবিধান তথা আল কুরআন নিয়ে এসেছে, তাই কুরআন নাযিল হওয়ার পর অন্যসব সংবিধান তথা ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ রহিত ও অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে। এটাই হলো যুক্তির দাবি।

কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা অন্য ধর্মকে গ্রহণযোগ্য বলে নিজের ঈমান যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনিভাবে অন্য মুসলমানদেরকে এই মতবাদে দীক্ষিত করে তাদের ঈমানও নষ্ট করে যাচ্ছে।

৪. কোয়ান্টামের উদ্ভাবিত জীবনদৃষ্টির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “কোয়ান্টাম হচ্ছে সেই সায়েন্স অব লিভিং যা বলে দেয় জীবনটাকে কীভাবে সুন্দর করা যায়। ভুল থেকে কীভাবে দূরে থাকা যায়। পাপ কত কম করা যায়। ভাল বা কল্যাণ কত বেশি করা যায়। কোয়ান্টামের শিক্ষা এ ক্ষেত্রে নবী-রাসূলদের যে শিক্ষা, ওলী-বুযুর্গদের যে শিক্ষা, মুনি-ঋষিদের যে শিক্ষা, তা থেকে আলাদা কিছু নয়। হাজার বছর ধরে তারা যে শিক্ষা দিয়ে এসেছেন, কোয়ান্টাম সে কথাগুলোই বলছে। শুধু ভাষাটা আধুনিক।” (হাজারো প্রশ্নের জবাব, মহাজাতক ১/৩০১)

এখানে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করা হলো যে, কোয়ান্টামের শিক্ষা হলো, নবী-রাসূলদের তাওহীদী বাণী ও মুনি-ঋষিদের কুফরী মতবাদের সমন্বিত একটি রূপ। অতএব সাবধান হে মুসলিম ভাই! কোয়ান্টামে দীক্ষা লাভ করে নিজের ঈমান খোয়াবেন না।

নবীজী মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত জীবনব্যবস্থার উপর সন্তুষ্ট হতে না পারা কোয়ান্টামের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। নিজের বুদ্ধিমতে সকল ধর্মের নির্যাস আর বিজ্ঞানের থিউরি মিশ্রণে সফলতার সূত্র আবিষ্কার সবচেয়ে বড় ভুল। মুমিন-মুসলমান হতে হলে সর্বাবস্থায় কুরআন-সুন্নাহর মাঝে নিজের সকল সমস্যার সমাধান, সকল প্রশ্নের উত্তর আর সকল চাহিদা পূরণের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়ার বিশ্বাস রাখতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থায় তুষ্ট থাকতে হবে এবং মনে-প্রাণে তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে নিজেকে সঁপে দিতে হবে। বিধাতা হিসেবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার উপর আস্থাশীল হতে হবে। নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শকে একমাত্র পালনীয় বিশ্বাস করতে হবে।

কোয়ান্টামের আবিষ্কৃত জীবন-যাপনের বিজ্ঞানের অনুসরণ করা যাবে না। যার ভিত্তি রাখা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত জীবনের সংজ্ঞা আর রুশ দার্শনিক লিওটলস্টয় এর কিছু মন্তব্যের উপর। মুসলমানদেরকে ইয়াহুদী-খ্রিস্টান বা তাদের স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী জীবন যাপনের বিজ্ঞান পালন করতে হবে কেন? মুসলমানদের জন্য ইসলামের বিধি-বিধান ও নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শই কি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থারূপে যথেষ্ট নয়। যারা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা মানবে না, তারা কুরআনের স্পষ্ট আয়াত ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পরিপূর্ণ করে দিলাম’ (সূরা মায়িদা : ৩) অস্বীকার করায় কাফির হয়ে যাবে।

কোয়ান্টাম মেথড নতুন জীবনদৃষ্টির কথা বলে মূলতঃ ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা অস্বীকার করছে। তাই যারা না বুঝে ইতিমধ্যে কোয়ান্টামে ঢুকে পড়েছেন অথবা যারা এখন ঢুকতে চাচ্ছেন, তারা এখনই সর্তক হোন, তাওবা করে সঠিক ইসলামের পথে ফিরে আসুন এবং পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলাম ধর্ম মেনে চলুন।

চৌদ্দশত বছর আগেই আল্লাহ তা‘আলা আপনার সব সমস্যার সমাধান কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে দিয়ে রেখেছেন। অতএব অন্য কোনো দিকে না যেয়ে আপনার ধর্ম ইসলামকে আঁকড়ে ধরুন। যারা পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলাম ধর্ম মেনে চলবে তাদের জন্য আখিরাতে চির শান্তির জীবন তো অপেক্ষা করছেই, দুনিয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য প্রশান্তিময় জীবনের ওয়াদা করেছেন। তাই আসুন আমরা কোয়ান্টামসহ অন্যান্য সব বাতিলকে পরিত্যাগ করি এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে চর্চা করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

পুরো লেখাটি পড়ুন : ISLAMIJINDEGI.COM

 41,197 total views,  13 views today


মন্তব্য (১ টি)

মন্তব্য করুন