মুহসিনুদ্দীন মাহমূদ ।।
এখন পর্যন্ত ‘কোয়ান্টাম মেথডের’ জ্ঞাত মতলব ‘মহাছলনা’ ও ‘মহাপ্রতারণার’ মাধ্যমে এর প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল আলম শিকদারের বিপুল টাকা কামানোর উৎসাহ।
শহীদ শিকদার পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকতা করতেন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। ভারতে কয়েকবছরের অবস্থানকালে তিনি যোগসাধনা এবং হস্তগণনায় দীক্ষা নেন। একসময় পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি প্রধান চাচা সিরাজ শিকদারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ফিরে আসেন। সিরাজ শিকদার নিহত হওয়ার পর ‘মহাজাতক’ নামে অর্থের বিনিময়ে হাতদেখায় মনোনিবেশ করেন।
তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা ‘সব জ্যোতিষ ভুয়া’ নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার পর মহাজাতকসহ জ্যোতিষদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। এতে আদালত হাতদেখায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তারপর তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রতিদিন রাশিফল লিখতেন। একপর্যায়ে ‘সিলভা মেথডের’ একটি কোর্সে মেডিটেশন বা ধ্যানানুষ্ঠানের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি নিজেই ‘যোগ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে অর্থের বিনিময়ে যোগসাধনা এবং মেডিটেশন পরিচালনায় নামেন। তিনি এসময় নিজে ‘শহীদ আল বোখারী’ নাম ধারণ করেন; সম্ভবত মুসলিম সমাজে পবিত্র হাদীসগ্রন্থ ‘সহীহ্ আল বোখারীর’ প্রতি যে আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে, তাতে ভাগ বসানোর কুমতলব থেকে। সেইসাথে তিনি তার পরিচালিত মেডিটেশনকে ‘কোয়ান্টাম মেথড’ নাম দেন; বিজ্ঞানের ‘কোয়ান্টাম থিওরির’ অনুকরণ করে, যদিও সেই থিওরির সাথে তার এই মেডিটেশনের কোনো সম্পর্ক নেই।
শহীদ আল বোখারীর কোয়ান্টাম মেডিটেশনের ফাঁদে যখন ইসলামী ধারার বেশকিছু ব্যক্তিত্ব পা দেন, তখন তাদেরই পরামর্শে তিনি পত্রিকায় রাশিফল লেখা এবং মহাজাতক নাম পরিত্যাগ করেন। এরপর থেকে দীনদার বিপুলসংখ্যক লোককে টেনে নেয়ার সুযোগ তার জন্য অবারিত হয়ে যায়। আনুমানিক কয়েক লক্ষ নারীপুরুষ এ’পর্যন্ত তার মনোদাসত্ব বরণ করেছেন।
শহীদ আল বোখারীর ‘যোগ ফাউন্ডেশন’ একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন অর্থোপার্জনমুখী প্রতিষ্ঠান। যেখানে মানুষ মোটা অঙ্কের দর্শনী দিয়ে তার কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন কোর্সে অংশ নেয়। তাদের অস্থির মন সাময়িকভাবে প্রশান্ত হয়। সাথে তারা একটা সম্মোহনের ভিতরে থেকে শহীদ আল বোখারীকে ‘গুরুজি’, তার স্ত্রীকে ‘মাজি’ ডেকে তৃপ্তি পায়। ফলস্বরূপ এই বিশাল ভক্তকুল অকাতরে শহীদ আল বোখারীর পদতলে তাদের সম্পদ ঢেলে দেয়।
‘যোগ ফাউন্ডেশনের’ পাশাপাশি শহীদ আল বোখারী জনসেবার কথা বলে ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ নামে ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যেখানে তিনি মেডিটেশন কোর্সে তার শিকার ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে ‘মাটির ব্যাংক’, ‘যাকাত’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে দান সংগ্রহ করে থাকেন।
‘যোগ ফাউন্ডেশন’ এবং ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’, এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি এককভাবে এমন সমন্বিত করে পরিচালনা করেন যে, লাখো মানুষের উৎসর্জনের মাধ্যমে এতদিনে তিনি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন টাকার পাহাড়।
পরিসংখ্যান
কোয়ান্টামের অভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্রহ করা অনেকদিন যাবত প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে কোয়ান্টামের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্নকারী শিষ্য এবং কর্মকর্তার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় তথ্যলাভের কিছুটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও গোপনতথ্য প্রকাশের কারণে সম্পর্কত্যাগীগণ কোয়ান্টামের পক্ষ থেকে নানা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করে শহীদ আল বোখারী ওরফে শহীদ শিকদারের মতলব হাসিলের মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান হাতে পাওয়া গেল। নিখুঁত পরিসংখ্যান কেবল যথাযথ তদন্তের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসতে পারে।
সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন কোর্স অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ সনের ১ জানুয়ারিতে। তখন কোর্স ফি ছিল জনপ্রতি ৩,৫০০ টাকা। সেই থেকে এ’পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা এবং বিদেশের মাটিতে প্রায় ৫০০ কোর্স সম্পন্ন হয়েছে। দেশের ভিতরে বর্তমানে কোর্স ফি ১০,৫০০ টাকা।
গড়ে প্রতিটি কোর্সে ৭,০০০ টাকার বিনিময়ে ৫০০ জন করে অংশগ্রহণ করেছেন ধরা যেতে পারে। এই হিসাবে কোর্স ফি বাবদ শহীদ আল বোখারীর ব্যক্তিগত আয় আনুমানিক (৫০০x৫০০x৭০০০) ১৭৫ কোটি টাকা। কারো কারো হিসাবে এই পরিমাণ আরো অনেক বেশি।
‘Quantum Crime’ নামের কোয়ান্টাম পরিত্যাগকারীদের একটি ফেইসবুক গ্রুপ কেবল ২০১৪ সাল পর্যন্তই কোর্স ফি বাবদ শহীদ আল বোখারীর ১৬৭ কোটি টাকা আয়ের ধারণা প্রকাশ করেছে।
সেই সঙ্গে গ্রুপটি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের নামে শহীদ আল বোখারী কি বিপুল পরিমাণ অর্থ দান বাবদ গ্রহণ করেছেন, তারও একটা আনুমানিক হিসাব প্রদান করেছে। সেটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। যার বিপরীতে খরচ ৪০ কোটি টাকাও নয়।
তাদের বিস্তারিত হিসাবটি পাঠক নীচের লিঙ্ক থেকে দেখে নিতে পারেন –
শহীদ আল বোখারীর দান সংগ্রহ এবং সেই দানের অর্থ ব্যয়ের ধরণটা কি জানেন? মাত্র দুটি উদাহরণ দেই –
১. তিনি তার ভক্তকুল থেকে যাকাত সংগ্রহ করেন; এরপর সেই যাকাতের অর্থ অনৈতিকভাবে ক্ষুদ্র ঋণ হিসাবে বণ্টন করে থাকেন, যা আবার তিনি উঠিয়ে নেন। ফলস্বরূপ দাতাদের যাকাত আর কখনো আদায় হয় না।
২. বান্দরবানের লামা কোয়ান্টামপল্লীতে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য তিনি ২০ কোটি টাকারও বেশি দান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু পূর্ববর্তী একটি টিনের মসজিদের সাথে একটা বারান্দা সংযোজন করা ছাড়া তিনি আর কোনো খরচ সেখানে করেননি।
কোয়ান্টামের অসংখ্য ফাঁদের কয়েকটি
শেষ কোথায়?
কোয়ান্টামের পদত্যাগকারী এক কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, শহীদ শিকদারের পরিবারে কে কে আছেন? তার নিজের বয়স, শারীরিক অবস্থা কী? তিনি যে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছেন, সেসব কোথায় খরচ করেন? কেন তার এত টাকা কামানো, কোনো ধারণা করতে পারেন কি?
উত্তরে সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, এবিএম শহীদুল আলম শিকদার দুলু প্রকাশ মহাজাতক শহীদ আল বোখারীর পিতা মৃত আব্দুল মান্নান শিকদার, মাতা মৃতা ফিরোজা বেগম, তারা মোট ৭ ভাই ও ৩ বোন। ২ ভাই মারা গেছেন। মহাপ্রতারক পিতার বড় সন্তান। ৩ বোনই বিবাহিতা। তার নিজের কোনো সন্তান নাই।
মহাপ্রতারকের জন্ম ১৯৪৭/৪৮ সালে; সেই হিসাবে তার বয়স ৭২/৭৩ বছর হবে। শরীর ফিটনেস ভালো আছে।
টাকা কামানো বা টাকার ধান্ধা এখন তার একটি শিল্প হয়ে গেছে। মানুষের টাকা হাতানো – এটা তার মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
57,268 total views, 43 views today
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।
মন্তব্য (১২ টি)
Opekkhay thaklam vai.
অক্টোবর ৭, ২০২০, ৩:০২ অপরাহ্নআগ্রহের জন্য অনেক ধন্যবাদ! পুরো লেখাটি দেয়া হলো। আশা করি প্রতিক্রিয়া জানাবেন!
অক্টোবর ১০, ২০২০, ১২:৪৫ অপরাহ্নদারুন বিশ্লেষণমূলক লেখনী !!!
অক্টোবর ১৪, ২০২০, ১০:২৬ পূর্বাহ্নধন্যবাদ আপনাকে, মন্তব্যের জন্য!
অক্টোবর ১৫, ২০২০, ৪:২৩ অপরাহ্নIf you have evidence- why don’t you take legal action?
ডিসেম্বর ১৮, ২০২০, ৭:১১ অপরাহ্নআপনার মন্তব্যটি খুবই মূল্যবান। ভুক্তভোগীরা এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করবেন আশা করি। আমি অবশ্য এখানে একজন পর্যবেক্ষকমাত্র। নিজে এর পাল্লায় পড়িনি।
ডিসেম্বর ২০, ২০২০, ১০:৪৩ অপরাহ্নআমি শিয়ার করলাম হযরত
ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০২১, ১১:৩১ অপরাহ্নসুন্দর লেখা। ফেসবুকে শেয়ার করলাম।
ডিসেম্বর ১২, ২০২০, ১:৩১ পূর্বাহ্নসুন্দর লেখা
আগস্ট ১৩, ২০২১, ৯:৫০ অপরাহ্নgood post
আগস্ট ১৩, ২০২১, ৯:৫০ অপরাহ্ন১. বর্তমানে কোর্স ফি ১০,৫০০ টাকা নয়, বরং ১১,৫০০ টাকা। এক হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামনের বছর ১২ হাজার টাকা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আপডেট করে নেয়ার অনুরোধ রইলো।
২. সিরাজ সিকদার মহাজাতকের আপন চাচা নন। দূরসম্পর্কের চাচা হতে পারেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী যতদূর জানা যায়, তাদের বংশ পদবী একই এবং কাছাকাছি এলাকার মানুষ তারা। ফলে, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিতে শহীদুল সিকদারের যোগ দেয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। মোদ্দা কথা, তিনি নিজে থেকে যতদিন নিজ পরিচয় প্রকাশ না করবেন, এবং এই ব্লগের তথ্যকে চ্যালেঞ্জ না করবেন, ততোদিন এটাকেই আমরা সত্য বলে মনে করবো।
আগস্ট ৩১, ২০২১, ৯:৪২ অপরাহ্নGood or somemissing…
এপ্রিল ২৫, ২০২২, ৯:২৫ অপরাহ্ন