মুহম্মদ নূরুল হুদা ।।
কুসংস্কার আর কুসংস্কার।
আরবের সর্বত্র তখন শুধু কুসংস্কারের রাজত্ব।
পবিত্র কাবাগৃহে শোভা পাচ্ছে ৩৬০টি মূর্তি।
মানুষ আল্লাহর কথা ভুলে মূর্তিপূজায় লিপ্ত।
সামান্য কারণেই দাউ দাউ জ্বলে উঠছে যুদ্ধের বিভীষিকা।
মানুষের হৃদয় থেকে যেন লোপ পেয়ে গেছে দয়ামায়া।
মানুষের মধ্যকার মানবিক বন্ধন যেন ছিন্ন হয়ে গেছে।
সে-সময়ে আরবে নানা ধরনের মেলা বসতো। এতে জড়ো হতো বিভিন্ন গোত্রের লোকজন। তারা কবিতার সুরে সুরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের কুৎসা রটনা করতো। ‘ওকাজ’ মেলা ছিল এই ধরনের সবচেয়ে বড় মেলা।
একবার এই ‘ওকাজ’ মেলায় বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। অতঃপর তা ধারণ করলো মারাত্মক হানাহানির রূপ। একটানা পাঁচ বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে লাগলো। এমনকি, কোরেশরাও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো।
পিতৃব্য আবু তালিবের সঙ্গে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শেষে শেষে যুদ্ধে যেতেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল পিতৃব্য ও অন্যান্য সহ-যোদ্ধার তীর কুড়িয়ে আনা।
হযরত এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেননি। তাই তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে যুদ্ধের বিভীষিকা উপলব্ধি করার সুযোগ পেলেন। তাঁর সম্মুখে উন্মোচিত হলো জীবনের আর একটি কঠোর বাস্তবতা। যুদ্ধের অভিশাপ তিনি দেখতে পেলেন স্বচক্ষে। এই অন্যায় যুদ্ধে অসংখ্য লোক আত্মাহুতি দিলো। বিধবা হলো অসংখ্য নারী, পিতৃহীন হলো অসংখ্য শিশু, নির্বংশ হলো অনেক পরিবার।
যুদ্ধ-শেষে, হযরত যুদ্ধের বিভীষিকা সম্পর্কে মানুষকে বুঝাতে লাগলেন। আর্তের কথা ভেবে তাঁর হৃদয় তখন ব্যাকুল। তিনি মানুষকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, যুদ্ধ নয়, শান্তিই মানুষের পরম প্রার্থিত ধন। জীবনের সুখ, সমৃদ্ধি আর যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্যের প্রথম শর্তই হলো শান্তি। এই প্রচারকার্যে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পিতৃব্য জুবায়েরকে সঙ্গী হিসেবে পেলেন।
হযরতের প্রচারকার্যে অচিরেই সুফল দেখা দিলো। তখন তিনি তাঁর কাজকে আরো সংহত করার জন্য কতিপয় উৎসাহী তরুণকে নিয়ে গঠন করলেন ‘হিলফ-উল-ফুযূল’ বা শান্তিসঙ্ঘ।
এই সঙ্ঘের উদ্দেশ্য ছিল পাঁচটি :
১. নিঃস্ব, আর্ত, পীড়িত ও দুর্গতদের সেবা করা।
২. অত্যাচারীকে যথাসাধ্য বাধা দেওয়া।
৩. অত্যাচারিতকে সাহায্য করা।
৪. দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
৫. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা।
হযরতের জীবনে এই শান্তিসঙ্ঘের একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা আছে। এই শান্তিসঙ্ঘের মাধ্যমেই তিনি সত্যপ্রচারের প্রথম দীক্ষা নিলেন। অচিরেই জনসাধারণের কাছে হযরতের জনদরদী ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
যেখানে দুঃখ-দুর্দশা আর বিপদ-আপদ, সেখানেই তিনি;
সেখানেই শান্তিসঙ্ঘের কোন সদস্য গিয়ে উপস্থিত।
বিধবার পর্ণ কুটিরে, পীড়িতের রোগশয্যায়।
ক্ষুধিতের অন্নহীন ঘরে – সর্বত্রই তিনি
সাহায্যের হাত প্রসারিত করলেন।
সেবা, ত্যাগ ও মানবপ্রেমের এমন নিদর্শন খুব একটা দেখা যায় না।
যতই দিন যেতে লাগলো, হযরতের চারিত্রিক সৌন্দর্যে ততই আরববাসী মোহিত হয়ে পড়লো। ক্রমে ক্রমে তিনি প্রত্যেকেরই আস্থা অর্জন করলেন। সবাই তাঁকে যে-কোন কাজে একবাক্যে বিশ্বাস করতে শুরু করলো। তরুণ মুহাম্মাদ অচিরেই হয়ে উঠলেন ‘আল-আমীন’ বা ‘বিশ্বাসী মুহাম্মাদ’।
ঘটনাচক্রে তাঁর ‘আল-আমীন’ নাম এত বেশি বিখ্যাত হয়ে উঠলো যে, এই নামের আড়ালে আসল নাম যেন ঢাকাই পড়ে গেলো। আসলে তরুণ মুহাম্মাদ ছিলেন তারুণ্যের একটি সর্বাঙ্গ-সুন্দর আদর্শ। সত্যবাদিতা, শৃঙ্খলা আর মানুষের প্রতি ভালবাসা তাঁর এই আদর্শের ভিত্তিভূমি।
হযরত জীবনে কোনোদিন এই হিলফ-উল-ফুযূলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।
32,929 total views, 11 views today
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।
মন্তব্য (০ টি)