ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্য বিষয়ে ইসলামের বিধান

মুফতী মনসূরুল হক ।।

আল্লাহ তা‘আলার নিকট মনোনীত ধর্ম ও একমাত্র শান্তিময় ধর্ম হলো ইসলাম ধর্ম, যাতে নেই কোনধরনের সঙ্কীর্ণতা ও লাগামহীন স্বাধীনতা এবং নেই এমন কোনো আদেশ যা পালন  করা  দুষ্কর এবং নেই এমন কোনো নিষেধ, যা বর্জন করা অসম্ভব। বরং তাতে রয়েছে সহজতা ও পূর্ণতা এবং ব্যাপকতা ও কোমলতা।

কিন্তু এই ধর্মের প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার দরুন মুসলিমদের মাঝে ইয়াহুদী, খ্রিস্টান, মুশরিক ও বিভিন্ন অমুসলিমদের সীমাহীন অপসংস্কৃতি ও অসভ্যতা অনুপ্রবেশ করেছে, যার অন্যতম হলো প্রাণীর ছবি আঁকা ও তোলা এবং ভাস্কর্য ও মূর্তি প্রস্তুত করা। তাই এই বিষয়ে ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সংক্ষেপে কিছু বিধি-নিষেধ উল্লেখ করা  হলো।

প্রাণীর ছবি আঁকা, বিনা ঠেকায় ছবি তোলা, সংরক্ষণ করা ও প্রদর্শন করার বিধান

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন প্রাণীর ছবি অংকনকারীরা সবচেয়ে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৯)। তেমনি হযরত আবু তালহা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ঘরে কুকুর কিংবা প্রাণীর ছবি থাকে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেন না। (সহীহ বুখারী, হা. ৫৯৪৯; সহীহ মুসলীম, হা. ২১০৬)। অন্য হাদীসে আছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করবে তাকে কিয়ামতের দিন বাধ্য করা হবে যেন সে তাতে প্রাণসঞ্চার করে, অথচ সে তা করতে সক্ষম হবেনা। (সহীহ বুখারী, হা. ৫৯৬৩; সহীহ মুসলিম, হা. ২১১০)। ঠিক তেমনি হযরত আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে অঙ্কিত কিছু দেখলে তা বিনষ্ট করে দিতেন। (বুখারী, হা. ৫৯৬২)।

এছাড়া আরো অনেক হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের আছার, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও ফুকাহা কেরামের কথা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোনো প্রাণীর ছবি আঁকা, বিনা ঠেকায় ছবি তোলা ও সংরক্ষণ করা বা প্রদর্শন করা সম্পূর্ণভাবে হারাম। ঠিক তেমনি কোনো ব্যক্তির ছবি, চাই সেটা কোনো আলিম বা বুযুর্গের ছবি হোক না কেন, নিজের সাথে বা ঘরে বরকত বা সৌন্দর্য কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা বা ঝুলিয়ে রাখা শরী‘আতের দৃষ্টিতে নাজায়িয তথা হারাম, বরং শাস্তি ও অভিশাপযোগ্য কাজ। (সহীহ বুখারী, হা. ৫৯৫১, ৫৯৫৩, ৫৯৫৪, ৫৯৫৫, ৫৯৬০, ৫৯৬২, ৫৯৬৪, ২২২৫, ১৩৪১; সহীহ মুসলিম, হা. ৯৬৯, ৫২৮, ২১১১, ২১১২, ২১০৭; নাসাঈ, হা. ৫৩৬৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৮৫৩; মুসান্নাফে আবদুররাজ্জাক্ব, হা. ১৯৪৯২, ১৯৪৮৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা. ২৫৭০৬, ৩৪৫৩৮; শরহুননববী, খ.২, পৃঃ ১৯৯; ফাতহুল বারী, খ. ১০, পৃঃ৪৭০; উমদাতুল ক্বারী, খ. ১৫, পৃ. ১২৪; ফাতাওয়ায়ে  আলমগীরী-৫/৩৫৯; ইমদাদুল মুফতীন, পৃঃ ৮২৯)

মূর্তি ও ভাস্কর্যের হুকুম

ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্ণূরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ, জায়িয হওয়ার কোনো সুরত নেই। হ্যাঁ, রয়েছে শুধু ঈমান চলে যাওয়ার আশংকা। এজন্যই ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, পূজার মূর্তি দুই কারণে হারাম, এক. প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ায়, দুই. পূজা করায়। আর সাধারণ ভাস্কর্য হারাম হওয়ার কিছু কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

ক. সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য তৈরি করা হারাম, এটা প্রাণীর প্রতিকৃতির কারণে নয়; বরং কোনো কোনো ভাস্কর্য নির্মাতা তার নির্মিত ভাস্কর্যের ব্যাপারে এতই মুগ্ধতার শিকার হয়ে যায় যে, যেন ঐ পাথরের মূর্তি এখনই জীবন্ত হয়ে উঠবে! এখনই তার মুখে বাক্যের স্ফূরণ ঘটবে! বলাবাহুল্য এই মুগ্ধতা ও আচ্ছন্নতা এই অলীক বোধের শিকার করে দেয়, যেন সে মাটি দিয়ে একটি জীবন্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছে। এ জন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যারা এসব প্রতিকৃতি তথা ছবি প্রস্তুত করবে, তাদেরকে কিয়ামতের দিন বলা হবে, তোমরা যা সৃষ্টি করেছ তাতে জীবন দাও। (সহীহ বুখারী, ৫৯৫৯)।

খ. আর যদি স্মরণ ও সম্মানের উদ্দেশ্যে বানানো হয়, তাহলে এটা যেমন প্রাণীর ছবি হওয়ার কারণে হারাম, তেমনি এ কারণেও যে, এভাবে কোনো ছবির সম্মান দেখানো এক ধরনের ইবাদাত বলেই গণ্য হবে। আর শয়তান এভাবেই ধীরে ধীরে মুসলমানদেরকে শিরকে লিপ্ত করায়, যেমনিভাবে শয়তান অতীত জাতিসমূহকে স্মারক ভাস্কর্য প্রস্তুত করার মাধ্যমে শিরকে লিপ্ত করিয়েছিল। কেননা পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের মাঝে এ ধরনের স্মারক ভাস্কর্য থেকেই পূজার মূর্তির সূচনা হয়ে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। (মাআরিফুল কুরআন, ৮/৫৬৬)।

গ. আর যেসব প্রাণহীন বস্তুর পূজা করা হয়, সেগুলোর ভাস্কর্য তৈরি করাও হারাম এটা পূজার কারণে, যদিও তা প্রাণীর ছবি নয়।

ঘ. আরো দেখা যায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ও প্রস্তুতকারীরা সীমারেখার পরোয়া করে না এবং নগ্ন ও অর্ধনগ্ন, নারীমূর্তি, মূর্তিপূজার বিভিন্ন চিত্র ও নিদর্শন ইত্যাদি বানিয়ে নিজেরা যেমন গুনাহগার হয়, তেমনি রাস্তার মোড়ে বা অলিতে গলিতে স্থাপন করে অন্যদেরকেও গুনাহগার বানায়।

ঙ. তদুপরি এগুলি হচ্ছে অপচয় ও বিলাসিতার পরিচায়ক। বিলাসী লোকেরা বিভিন্ন উপাদানে নির্মিত ছবিসমূহের মাধ্যমে তাদের কক্ষ, অট্টালিকা ইত্যাদির সৌন্দর্য বর্ধন করে থাকে। ইসলামের সাথে এই অপচয় ও বিলাসিতার কোনো সম্পর্ক নেই।

এজন্যই তো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কাবিজয়ের সময় বাইতুল্লাহ ও তার চারপাশ থেকে সব ধরনের মূর্তি অপসারণ করেছিলেন এবং সকল মূর্তি ও ভাস্কর্য বিলুপ্ত করেছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সব ধরনের প্রতিকৃতি মিটিয়ে ফেলার আদেশ করেছিলেন। তারপর বিভিন্ন স্থানে খোদিত ছবিগুলি সাহাবায়ে কেরাম (রা.) পানিতে কাপড় ভিজিয়ে, ডলে ডলে সমান করার চেষ্টা করেছিলেন, এরপর অবশিষ্ট খোদিত চিত্র মাটির লেপ দিয়ে জাফরানের রং লাগানো হয়েছিল। (বুখারী, হা. ২৪৭৮, ৪২৮৭, ৪৭২০, ৪২৮৮; মুসলিম, হা. ১৭৮১; আবু দাউদ, হা. ২০২০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হা. ৩৮০৭৪; ইবনে হিব্বান, হা. ৫৮৬১, ৫৮৫৭; সিরাতে ইবনে হিশাম, ৪/৬৫; তারীখুল ইসলাম যাহাবী ১/৩৯৭-৩৯৮; শরহুননববী, ২/১৯৯; উমদাতুলকারী, ১৫/১২৪)।

সৌজন্যে : ইসলামী যিন্দেগী (islamijindegi.com)

 3,580 total views,  27 views today


মন্তব্য (২ টি)

  • נערות ליווי בקיסריה বলেছেন, জবাব

    I was pretty pleased to discover this web site. I want to to thank you for your time for this fantastic read!! I definitely really liked every bit of it and I have you book marked to see new things on your web site.

    এপ্রিল ২০, ২০২৩, ৬:১৮ অপরাহ্ন
  • https://iloveroom.co.il/room/דירות-דיסקרטיות-בקריות/ বলেছেন, জবাব

    Good post. I learn something new and challenging on blogs I stumbleupon on a daily basis. Its always exciting to read content from other authors and use a little something from other web sites.

    মে ৮, ২০২৩, ৬:৪৭ অপরাহ্ন

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না