ড. আকবর আলী খান ।।
সনাতন হিন্দুধর্ম চার বর্ণভিত্তিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই চার বর্ণের মধ্যে সবার ঊর্ধ্বে ছিল ব্রাহ্মণরা, তারপর ছিল ক্ষত্রিয়রা। ক্ষত্রিয়দের নিচের অবস্থানে ছিল বৈশ্যরা। অনেকের মতে সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল শূদ্ররা।
উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সব সময়ই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার করেছে। শূদ্র ও দলিতরা এ ধরনের অত্যাচারে খুবই ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু হিন্দুধর্মের আওতায় তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। যখন ইসলাম ধর্ম এ দেশে এল, তখন ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পথ দেখা গেল।
ইসলাম ধর্ম বর্ণবাদে বিশ্বাস করত না এবং সকল মুসলমান ভাই ভাই – এ আদর্শেই ছিল তাদের বিশ্বাস। বাংলার কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, বাংলার নিম্নবর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশ চিরকালই দুর্দান্ত – স্বাধীনতাপ্রিয় সিংহকে খাচায় পুরিলে সে যে রূপ শৃঙ্খলকে দুঃসহ মনে করিয়া ছটফট করিতে থাকে, অত্যধিক ব্রাহ্মণ-শাসনে পীড়িত হইয়া বাঙ্গালী এই দৌরাত্ম্যের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে ব্যাকুল হইল। ব্রাহ্মণেরা মন্দিরগুলি আত্মসাৎ করিয়া দেবতাদিগকে আড়াল করিয়া দাঁড়াইলেন, জনসাধারণ ও তাহাদের মধ্যে এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর উত্থিত হইল। অভিমানে এ দেশে অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিল।’ (বৃহৎ বঙ্গ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৯৭)
ধরে নেয়া হয়, হিন্দুদের অনন্য বর্ণপ্রথা ‘বাংলার প্রায় উভচর (semi-amphibious) আদিবাসীদের প্রভুগোষ্ঠীর সেবার উদ্দেশ্যে কাঠুরে আর পানিবাহকে পরিণত করেছিল; এই প্রভুদের দৃষ্টিতে তারা ছিল নোংরা পশু, ঘৃণিত জীব মাত্র’। (H. Beverley 1872, Op.cit. p.132)
যুক্তি দেখানো হয় যে, এক অবজ্ঞাত ও লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীর সামনে ইসলাম তুলে ধরেছিল ঈশ্বরের একত্ব মানুষের সাম্যের ধারণা; এরই ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম গ্রহণে প্রণোদিত হয়েছিল। (T.W. Arnold, 2010, Op.cit. p.3)
দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাদে দেখা যায় যে, ব্রাহ্মণেরা উপমহাদেশের সর্বত্রই সমভাবে ঘৃণিত। ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা ‘দেখতে সাধু কিন্তু অন্তরে কসাই।’ নিম্নোক্ত প্রবাদটি ব্রাহ্মণদের প্রতি ঘৃণার প্রমাণ দেয়, ‘ইস দুনিয়া মে তিন কসাই/পিশো, খাটমল, ব্রাহ্মণ ভাই’ (এই দুনিয়ায় আছে তিন ধরনের রক্তচোষা – মশা, ছারপোকা আর ব্রাহ্মণ ভাই)। (Risley, 1915, Op.cit. p.131)
উদাহরণস্বরূপ মাদ্রাজের কথা তুলে ধরা যায়; সেখানে ধরে নেওয়া হয় যে, একজন নিম্নবর্ণের অচ্ছুত যদি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণের ষাট ফুটের মধ্যে ঢুকে যায় তবে উচ্চবর্ণের হিন্দুকে অপবিত্র গণ্য করা হতো। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো এলাকায় ব্রাহ্মণদের আসতে দেখলে শূদ্রদের রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়, অথবা মধ্যযুগে ইউরোপে কুষ্ঠরোগীদের যেমন বিশেষ এক ধরনের শব্দ করে তাদের আগমনের সংবাদ দিতে হতো, তেমনি শব্দ করে চলতে হতো। (Risley, 1915, Op.cit. p.131)
বাস্তবে বাংলাকে জঘন্যতম ধরনের ব্রাহ্মণদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে এ ধরনের অত্যাচার ছিল তীব্র।
বাংলার বেশিরভাগ মুসলমানই নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন – এই উক্তির তাৎপর্য এই নয় যে যেহেতু তাঁরা নিম্নবর্ণের হিন্দু হিসেবে সনাতন সমাজব্যবস্থায় অত্যাচারিত ছিলেন, সেহেতু তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ ধরনের ব্যাখ্যায় ধর্মান্তরের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য একেবারেই অস্বীকার করা হয়। বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মুসলমান হননি, তাঁরা ইসলামের আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
মুসলমান অভিজাত ঐতিহাসিকেরা বিশ্বাস করেন যে বাংলায় বেশির ভাগ মুসলমান নিম্নবর্ণের হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে এ ধরনের বক্তব্যে মুসলমানদের অপমান করা হয়। … ড. রহিম তাঁর রচিত বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গ্রন্থের ১ম খণ্ডে যেসব কুলীন পরিবার থেকে ইসলামে ধর্মান্তর হয়েছে, তাদের বর্ণনা দিয়েছেন। এ ছাড়া অসীম রায় তাঁর The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal বইয়েও বাংলার কুলীন হিন্দুদের ধর্মান্তর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া ড. মোহর আলীও তাঁর History of the Muslims of Bengal-এ (খণ্ড-১ বি) এ সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রদান করেছেন। তবে এই তথ্যাদির পর্যালোচনা করলে কেবল এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে বাংলায় শুধু নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই ইসলাম গ্রহণ করেনি, উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও ধর্মান্তরিত হয়েছে। ধারণা করা যায়, ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে কুলীনদের হার বেশি ছিল না।
এই অনুমানের পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো এই যে বাংলায় কুলীন পরিবারেরা সহজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে কুলীনদের জাত খোয়া যেত। জাতিভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কুলীনরা হিন্দু ধর্মের আওতায়ই থেকেছে, মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করেনি। নগেন্দ্রনাথ বসুর বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে ৬০টির অধিক কুলীন হিন্দু পরিবার যবনদোষে আক্রান্ত হয়, কিন্তু তারা কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। এদের মধ্যে কলকাতার পিরালি ব্রাহ্মণ, শেরখানি ব্রাহ্মণ এবং শ্রীমন্তখানি ব্রাহ্মণদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(ঈষৎ সংক্ষেপকৃত)
34,143 total views, 1 views today
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।
মন্তব্য (০ টি)