ভবানী প্রসাদ সাহু ।।
জন্মসূত্রে আপনি হয়তো এক হিন্দুনারী, ছোটবেলা থেকে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনে এসেছেন। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা থেকে যুধিষ্ঠির-দুর্যোধন- দুঃশলাদের কথা জানেন। আপনি হয়তো এক গরীব পরিবারের মেয়ে, স্কুলে এইট-নাইন অব্দি পড়ার পর আর পড়া হয়নি। তারপর কোনরকমে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কিংবা মোটামুটি সচ্ছল এক পরিবারে আপনার জন্ম; গ্রাজুয়েট হয়েছেন; একটি ছোট স্কুলে চাকরিও করছিলেন, এমন সময় বিয়ের সম্বন্ধ আসায় বা নিজে দেখেশুনেই একজনকে বিয়ে করলেন – চাকরিটা হয়তো ছাড়তে হলো, বা কোনরকমে চাকরিটা করেও গেলেন। অথবা আপনি একজন উচ্চশিক্ষিতা, হয়তোবা ডাক্তার, কিংবা ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা অধ্যাপিকা; নিজে ভালোবেসে বা বাড়ির যোগাযোগে একজনকে বিয়ে করেছেন। কিংবা হয়তো অন্যধরনের কিছু, কিন্তু সদ্য বিবাহিতা।
বিয়ের কিছুদিন পরে দূরে কোথাও বেড়াতে গেছেন। হয়তোবা শৈলশহর, কিংবা সমুদ্রতট অথবা জঙ্গলে ঘেরা মনোরম জায়গা। দু’জন মিলে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় কেউ একজন আপনার স্বামীকে বোকা বানিয়ে বা কুপোকাত করে, আপনাকে ধরে নিয়ে পালিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আপনার স্বামী জানতে পারলেন, কোনো এক অভিজাত ব্যক্তি আপনাকে অপহরণ করেছে এবং আটকে রেখেছে, আর সমানে আপনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। তার পরিচিত মেয়েদের বসিয়েছে আপনার পাহারায় যাতে আপনি পালাতে না পারেন।
কিন্তু একদিন পুলিশ আর বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য নিয়ে, অনেক পরিশ্রম করে আপনার স্বামী আপনাকে ঐ বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করলেন। দীর্ঘদিন পরে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতের পুলকে আপনি তখন তীব্র আনন্দ আর বেদনায় ভাসছেন। কিন্তু ঐ সময় ঐখানে আপনার ঐ প্রিয়তম স্বামী আপনাকে বললেন ঐ বন্দীদশায় আপনি যে সতী ছিলেন, অর্থাৎ যৌনমিলন করেননি, তার প্রমাণ দিতে হবে, ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হবে – তারা আপনার যোনি পরীক্ষা করবেন, প্রয়োজনে প্রস্রাব পরীক্ষা করে গর্ভবতী কিনা জানবেন, ইত্যাদি। তখন আপনার কেমন লাগবে?
আপনি নিশ্চিত যে, বন্দীদশায় আপনার সঙ্গে কারো যৌনমিলন হয়নি। তবু আপনি রাজি হলেন এবং ডাক্তাররা রায় দিলেন, না, আপনি ধর্ষিতা নন। একমাত্র তখনই আপনার স্বামী আপনাকে গ্রহণ করলেন।
এরপর তো সবাই মিলে বাড়ি এলেন। বেশ সুখে ঘরসংসার করছেন। আপনার জরায়ুতে এল আপনার স্বামীর সন্তান। কিন্তু ঐ সময় একদিন আপনার স্বামীর কানে এল, পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজন আপনাকে সন্দেহ করছে, দীর্ঘদিন বন্দী অবস্থায় আপনার যৌনজীবন সম্পর্কে তারা সন্দিহান। (কারণ, তারা তো আগের ডাক্তারি পরীক্ষার কথা জানে না, জানলেও তাদের সামনে হয়নি।) মনে করা যাক, আপনার স্বামী একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, জনসমক্ষে নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে হবে। কিংবা তিনি একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তিনি চারপাশের লোকজনকে সন্তুষ্ট রাখতে চান। আপনার দেবরকে ডেকে বললেন, “যাও, বৌদিকে এ ঘর থেকে দূর করে অন্য কোথাও রেখে এস।” কিংবা বাপের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিতে বললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুঃখও পেলেন, তা-ও আপনি জানেন। তবু এভাবে বিতাড়িত হবার পর আপনার কেমন লাগবে?
তা সত্ত্বেও, স্বামীর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে আপনি দিন কাটাতে থাকলেন। সন্তান হলো। ঘটনাক্রমে একদিন শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। ছেলের খবর শুনে স্বামী আর থাকতে পারলেন না। সসম্মানে, ভালোবাসায় আপনাকে ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু এতদিন তো আপনি ঘরছাড়া। তাই আপনার স্বামী (হয়তোবা পাড়ার লোকজন বা বন্ধুবান্ধবদের চাপে) আবার চাইলেন আপনার চরিত্রের শুদ্ধতা যাচাই তথা ডাক্তারি পরীক্ষা ইত্যাদি। না, আপনার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আপনি ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহত্যা করলেন।
আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, এমন স্বামী কি আপনি চান? দরিদ্র, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত, যে পরিবার থেকেই আপনি আসুন না কেন, ঠিক এমন, যেমন ব্যবহার তখনকার দিনে ‘শ্রীরামচন্দ্র’ নিজের স্ত্রী সীতার প্রতি করেছিলেন, তেমন ব্যবহার কি আপনার কাম্য? আপনি ‘রামায়ণ’ পড়েছেন। তাই রামের এমন ব্যবহার আপনার জানা। আপনি যদি জানেন যে আপনার ভাবী স্বামী রামের মতো ব্যবহার আপনার সঙ্গে করবেন, তবে কি আপনি ঐ ব্যক্তিকে বিয়ে করবেন? সত্যি কথা বলুন!
রামায়ণের গল্পে রামের যে চরিত্র আঁকা হয়েছে, তা গল্পের চরিত্র হিসেবে যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি তার জীবনের মধ্য দিয়ে যে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে তা হয়তো তখনকার সমাজের পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল কিংবা আরো সঠিকভাবে বললে, তা হয়তো তখনকার শাসকগোষ্ঠীর কাছে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। রামায়ণ নিয়ে বা রামের চরিত্র নিয়ে সূক্ষ্ম গবেষণার মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, রামের চরিত্রের এমন দিকটি এখনকার কোনো মেয়ে, এমনকি রামভক্ত নারীও, অতি সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত নন।
রাম সীতার প্রতি উপর্যুপরি যে ব্যবহার করেছেন, তা একটি মেয়ের কাছে যতটা অপমানের ও বেদনার, ততটা অপমান ও বেদনার সামান্য অংশও খোলা মনে বিনা দ্বিধায় কোনো মেয়ের পক্ষে মেনে নেয়া মুশকিল। তবে সামান্যতম সম্মানবোধ যদি না থাকে ও সম্পূর্ণ সহায়সম্বলহীন যদি হন, তবে হয়তো ছবিটা কিছু পাল্টাবে। তখনও ব্যাপারটা বাধ্য হয়ে মানার মতো।
এই যদি অবস্থা হয়, তবে কেন এখন, রামায়ণ রচনার এই আড়াই-তিন হাজার বছর পরে আবার ঐ রাম-মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্যোগ এবং এতে মেয়েদের সামিল করা?
রামচরিত্রের ভাল দিকও কিছু আছে, মন্দ দিকও আছে। মোহমুক্তভাবে তাকে বিচার করা দরকার। কিন্তু তা না করে তাকে এক অবশ্য অনুসরণীয়, আদর্শ চরিত্র বলা বা ‘রামভক্তিই রাষ্ট্রভক্তি’, এমন উন্মাদসুলভ কথাবার্তা বলা আদিম ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পদক্ষেপমাত্র, যার আভাস পাওয়া যায় অযোধ্যায় মধ্যযুগীয় কাণ্ডকারখানার মধ্যে, ভিন্ন একটি বিশ্বাসের সৌধকে পরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করার মধ্য দিয়ে।
23,054 total views, 6 views today
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।
মন্তব্য (০ টি)